৪ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৫:২৩

গণতন্ত্রের সালতামামি

-গণতন্ত্রের সালতামামি

সত্যিকার অর্থেই কে এম নুরুল হুদা কমিশন ইতিহাসের সব থেকে নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। সামান্য হলেও সেই কমিশনের একজন, হয়তো কবি-গদ্যকার বলে, বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাশাসিত মানুষ কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে ধন্যবাদ জানানো যায়। তিনি হয়তো কিছু করতে পারেননি; কিন্তু তার প্রতিবাদের স্মারকটি ঠিকই চিহ্নিত করে গেছেন সময়ে সময়ে। সর্বশেষ তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন এখন আইসিইউতে আর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে।’

গণতন্ত্র আসলে আমাদের দেশে চর্চিত হয় এটা বললে গণতন্ত্রকেই অপমান করা হবে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শাসনতন্ত্র থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে একদলীয় বাকশাল সরকার ব্যবস্থা কয়েম করা হযেছিল; কিন্তু যখন সেই গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করা হয় তখন গণতন্ত্রের অনেক অংশেরই কোনো কার্যকারিতা ছিল না। কিছু কিছু অংশ নির্বোধ হয়ে পড়ে। তারপরও চলছিল। ৮০-এর দশকে এসে সেই গণতন্ত্রের পেটে পেরেক মেরে সৃষ্টি করা হয় সামরিক গণতন্ত্র। এই সামরিক গণতন্ত্রকে গণ-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে উৎখাত করা হলেও নতুনরূপে যে গণতন্ত্র ভূমিষ্ঠ হলো, তার অনেকাংশই রাজনৈতিক স্বার্থের রোষে পড়ে ডিশেইপড বা বিকৃত হয়ে জন্মাল। গণতন্ত্রের মৌলিকত্বই সেখানে নিগৃহীত হলো না, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকারপ্রধানের পকেটে। নদ-নদীর স্রোত যেমন সাগরে গিয়ে মেশে, তেমনই আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের সব ক্ষমতার ধারক হলেন সরকারপ্রধান। তার পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিছুই করতে পারেন না। এটাই কাটছাঁট করা সংবিধানের রাজনৈতিক দর্শন। আর ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বরে এসে আমরা দেখছি সেই গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে।

গত এক বছরের হিসাব নিলে প্রথমেই আসে এই মুহূর্তে চলমান তৃণমূল নির্বাচনের বিষয়টি। তৃণমূলের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে জনগণের ভোট দেয়ার স্বাধীনতা ভোগ করেছে ইউপি নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রার্থীরা, বিশেষ করে যারা নৌকার প্রার্থী, তারাই বাহুবলে, অস্ত্রবলে দাপিয়ে বেরিয়েছে ইউপি নির্বাচনের সীমানা। আর প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য গুলি করতে বাধেনি সেই সব ক্ষমতাদর্পী তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীর।

গোটা বছরটি গেছে রাজনৈতিক কর্মসূচির রক্তাক্ত পরিবেশ রচনার ভেতর দিয়ে। জাতীয় জীবনে যে রাজনৈতিক হানাহানি ছিল বা চলছিল, তা এখন কেবল দলীয় নেতাকর্মীদেরই প্রভাবিত করেনি, নির্দলীয় প্রার্থীদের একইভাবে ক্ষুব্ধ ও উত্তাল করেছে। ফলে সারা দেশেই ইউপি নির্বাচন আমাদের জাতীয় নির্বাচনেরই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যেতে পারে। তবে এবার বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হলো দলের নমিনেশন না পাওয়া, বঞ্চিত আওয়ামী লীগাররা। তবে দুই-চারজন যে বিএনপির তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছিলো না নির্দলীয় নিরপেক্ষতার ব্যানারে, তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? যদিও তা উল্লেখ করার মতো নয়। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে যে সব খুনের ঘটনা ঘটেছে, তা আওয়ামী বনাম আওয়ামী হিসেবেই ঘটেছে। ভোটাররা যাতে ভোট দিতে কেন্দ্রে না যায়, সেই সন্ত্রাসী হুমকি তো ছিলোই, প্রতিপক্ষ বিজয়ী হওয়া প্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এ রকম ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটেছে। এ পর্যন্ত কত মানুষ খুন হয়েছে সে হিসাব এর মধ্যেই দেশবাসী জানতে পেরেছে। ইউপি নির্বাচন ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়িয়েছে। সে সময় আরো কত প্রাণ যাবে তা আগাম বলা যাচ্ছে না। আওয়ামী নেতারা বলে থাকেন, নির্বাচনে এটা ঘটতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচন বলে কথা।

নির্বাচনে মানুষের চেয়ে ভোটের মূল্য অনেক বেশি। সেটি তো ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বর্তমান সরকার জাতিকে দেখিয়ে, বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষমতার মসনদে গেছে। অতএব গ্রামের নির্বাচনে যদি শ’কয়েক লোক (তারা মানুষ নয়) মারা যায়, তাতে ক্ষমতার কি এমন ক্ষতি? কিন্তু একটাই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের তরফ থেকে, যারা হত্যার শিকার হলো, যাদের জন্য তাদের প্রাণ গেল, সেই সব বিজয়ী কিংবা হারু ক্যান্ডিডেটের পক্ষে কি ওই মৃত লোকগুলোকে জীবিত করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কেন ওই লোকগুলোর প্রাণ কেড়ে নেয়ার আয়োজন হলো? কেন তাদের উসকে দিয়ে হত্যার মতো জঘন্য কাজের হুকুমদাতা হলেন তারা।

২.
রাজনীতির সালতামামি নেই। তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন ও তার কীর্তি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। এ বছরও প্রধান আলোচ্য ছিল করোনাভাইরাস। ভারতীয় ডেল্টা এসে আমাদের আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। বছরের শেষভাগে এসে সাউথ আফ্রিকান ওমিক্রন ভয়ার্ত বিশ্ববাসীকে যেমন চমকে দিয়েছিল, তেমনি আমাদেরও। ওমিক্রনের ঘাতকশক্তি ডেলটার মতো শক্তিশালী নয়, এটাই যা আশার কথা। প্রায় প্রতিটি দেশই করোনাভাইরাসের টিকা দিয়েছে তাদের নাগরিককে। এখন বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশও বুস্টার ডোজ দিচ্ছে। ফলে জনগণের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। এ কাজে, টিকা দেয়ার কাজে, কিছু সমস্যা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সাফল্য বেশির ভাগই হবে বলে আশা করছি আমরা। সরকারের এই টিকা সংগ্রহ ও টিকা দেয়ার কার্যক্রম সাধুবাদ পেতে পারে। মৃত্যুর হাত থেকে অনেক মানুষ বাঁচতে পারেনি ঠিক; কিন্তু তারও চেয়ে বেঁচে ওঠা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। সেই সাথে গণমানুষের সৎসাহস, করোনাসংক্রান্ত বিধিবিধান মেনে চলায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে এসেছে।

বছরের একেবারে শেষে এসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রোয়াসুস আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে ডেল্টা ও ওমিক্রনের মিলিত সংক্রমণ মহামারীকে সুনামিতে রূপান্তর করে ফেলতে পারে। এই সতর্ক বার্তাকে মোকাবেলা করতে হলে, কেবল মনের জোর আর সাহস থাকলেই হবে না, মুখে মাস্ক, হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়া অন্যতম প্রধান কাজ বলে গণ্য হবে।

আলোচনা হচ্ছে- হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে বিদেশী করোনার টিকা কেনার পরিবর্তে দেশেই কেন টিকা উৎপাদন করা হলো না, এ নিয়ে। দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিগুলো করোনার টিকা উৎপাদনে সক্ষম; কিন্তু ওই ব্যাপারে সরকারের সায় নেই বললে কি ভুল বলা হবে? এখন আলোচনা চলছে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি করে ইসি গঠনের কাজ করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ও সুপারিশ নিয়ে। রাষ্ট্রপতির এরকম উদ্যোগে আগেও ইসি গঠিত হয়েছে, কোনো ফল পাওয়া যায়নি। সরকারের লেজুড় হওয়া ছাড়া নির্বাচন কমিশনের কোনো ন্যায়সঙ্গত অবদান নেই। স্থানীয় সরকারের ইউপি নির্বাচনে মানুষ হত্যার ঘটনা অব্যাহত থাকলেও হুদা কমিশন নির্বিকার। নতুন যে সার্চ কমিটি হবে, সেটি তো সম্মতি ছাড়া হতে পারবে না। সংবিধানের ৪৮[৩] অনুচ্ছেদ অনুয়ায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া ছাড়া বাদবাকি কাজ প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ভিত্তিতেই করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। এর পর কি এ কথা লেখা উচিত হবে যে, আসন্ন নতুন কমিশনে যারা আসবেন তারা সবাই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্ধারিত তার খাস লোক হবে না। তারা দলনিরপেক্ষ হবেন এবং নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, রিগিংবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করতে অবদান রাখতে পারবেন। সত্য হচ্ছে, যে ইসি গঠিত হতে যাচ্ছে, তারাও আরো কিছু নির্বাচন মধ্যরাতে কিংবা প্রথম রাতেই সম্পন্ন করে আবারো পুলিশ, র্যাব সদস্যদের নির্বাচনোত্তর মিষ্টি খাওয়ার অনুষ্ঠান করবেন। আমরাই কতিপয় তার জন্য ধন্যবাদ দেবো সরকার ও নতুন নির্বাচন কমিশনকে।

এ এক মজার খেলা।
বিএনপি সার্চ কমিটি গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রপতির আলোচনায় যোগ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। যদিও রাষ্ট্রপতি আজো তাদের কোনো চিঠি দেননি। আর আওয়ামী লীগ পাত্তাই দিচ্ছে না বিষয়টি। কারণ তাদের জানা আছে, দলের প্রধানই তো ঠিক করবেন কে সিইসি হবেন আর কারা কারা কমিশনার। অতএব ভাবনার কী আছে!

এসব করতে রাষ্ট্রপতির আসলে কোনো কিছু করার নেই। সংবিধানে সার্চ কমিটি বলে কিছু নেই। সেখানে ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুয়ায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। সেটি আইন প্রণয়ন যারা করেন, সেই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদের সব সদস্যই (সরকারি ও বেসরকারি) বিল উপস্থাপন করতে পারেন নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুকারী-অনুসারীরা ওই পথে হাঁটেননি। তারা চান কে এম নুরুল হক মার্কা আরেকটি নির্বাচন কমিশনই হয়তো চান। যা আওয়ামী লীগকে ২০২৩ সালেও ভূমিধস বিজয় এনে দেবে।

রাষ্ট্রপতি আদিষ্ট হয়ে কমিটি করবেন, কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন এবং তার আচরণ কোনো দিনই একজন টিপিক্যাল আওয়ামী লীগারের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। তিনি যে আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য, একজন ডেপুটি স্পিকার, একজন স্পিকার ছিলেন এবং এখন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, সেগুলো তিনি ভুলে যাবেন কেমন করে? বলা হয়, রাষ্ট্রপতি কোনো দলের সদস্য নন, তিনি সব দলের, সবার জন্যই তার দরবার উন্মুক্ত। তিনি দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য নির্দলীয়, নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন; কিন্তু করেননি। প্রধানমন্ত্রী শ্লেষের সাথে বলে থাকেন, খালেদা জিয়ার প্রতি মানবিক আচরণ করছেন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, তাকে কারাগারে ফিরে গিয়ে আবারো আবেদন জানাতে হবে। আইনমন্ত্রী নিয়ে কি তামাশা করছেন?

খালেদা জিয়া কনভিকটেড আসামি। তাই তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসা নেয়ার অধিকারহীন। আইন যদি এমনটা থাকে, তাহলে বলতেই হবে, ওটা ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত আইন। আর দেশের আইন যদি হয় তাহলে তা মানুষের বিরুদ্ধে তৈরি করা একটি কালো আইন। আইন মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে, মানুষের অপরাধ শনাক্ত করতে সৃষ্টি করা হয়েছে; কিন্তু মানবতা ছাড়া আইন সৃজন হতে পারে না। কনভিকটেড আসামিরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। সংবিধান সে কথায়ই বলে।

সংবিধানে প্রত্যেকের জীবনরক্ষা, চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, জীবন বাঁচানোর অধিকার রয়েছে, যার সব দায়িত্ব সরকারের। কোনো প্রাণেরই যাতে কোনো হীনকর অবস্থা সৃষ্টি হতে না পারে, সেটা রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এসবই লঙ্ঘিত হয়েছে। তিনি যদি আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তার দায় সরকারের এবং সরকারপ্রধানের। খালেদা জিয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রীবে হত্যার চেষ্টা করেছেন বলে যে প্রচারণা তা কোনো আদালতে প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়। আদালত যতক্ষণ পর্যন্ত কাউকে অপরাধী হিসেবে গণ্য না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে হত্যাকারী বলা অপরাধ বা অন্যায়। সাংবিধানিক অধিকার এড়ানো উচিত নয়।

আমাদের এরকম রাজনীতির যেন অবসান হওয়ার নয়। আর তাই তার সালতামামিও নেই। এই রাজনীতির অবসান হলেই কেবল তামামি শব্দটি লেখা যেতে পারে। চলমান এই রাজনীতির চির অবসান হওয়া অতীব জরুরি। কারণ এই রাজনীতি আমাদের মানসিকভাবে আহত করছে, নিহত করছে এবং কবর রচনা করছে আমাদের স্বপ্নের। আমরা কোনো স্বপ্নেরই কবর রচিত হতে দেবো না।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/634058