২৫ জুন ২০২১, শুক্রবার, ১:১২

সরকারের ৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত লাখ লাখ শ্রমিক

মহামারি করোনার কারণে পোশাক কারখানার লাখ লাখ শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছে। পোশাক কারখানা মালিকদের জন্য সরকারের ৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজও শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। গত এক বছরে ছাঁটাই কিংবা কর্মচ্যুতির শিকার হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। এছাড়াও করোনাকালে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি কমেছে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত।

জানা গেছে, ‘দ্য উইকেস্ট লিঙ্ক ইন দ্য গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন: হাউ দ্য প্যানডেমিক ইজ অ্যাফেক্টিং বাংলাদেশ’জ গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন গত এপ্রিলের শেষে প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, পোশাক কারখানাগুলো গড়ে তাদের ১০ শতাংশ শ্রমিককে হয় ছাঁটাই করেছে, না হলে ছুটিতে পাঠিয়েছে। আর স্বল্প ক্রয়াদেশ ও নতুন ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে পণ্যের দাম কমে যাওয়ার পাশাপাশি দাম পরিশোধে বিলম্বের মতো পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই হার ৩৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। গ্লোবাল ওয়ার্কার্স রাইটসের গত বছরে করা এক জরিপের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এ সময়ে বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়া ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক তাদের বকেয়া মজুরি পাননি। একই ঘটনা ঘটেছে লে-অফের শিকার ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিকের ক্ষেত্রে। ইউএনডিপি বাংলাদেশ ও সুইডিশ সরকারের সরকারের সহযোগিতায় প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে দ্য ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড বিজনেস এবং বার্কলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সুবীর অ্যান্ড মালিনী চৌধুরী সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ। যেহেতু এই মুহূর্তে কারখানাগুলোতে শ্রমিক নিয়োগ এক প্রকার বন্ধ আছে, তাই কাজ হারানো শ্রমিকদের অনেকে এখন পর্যন্ত বেকার জীবনযাপন করছেন। আবার অনেকে বেছে নিয়েছেন দিনমজুরির পেশা।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পোশাক কারখানার অন্তত ৩৫ জন বর্তমান ও সাবেক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। গত বছর করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর হয় তারা কাজ হারিয়েছেন নয়তো তাদের মজুরি কাটা পড়েছে। এই ৩৫ জন শ্রমিকের প্রত্যেকে জানিয়েছেন, মহামারির কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থার কারণে কারখানা বন্ধ হওয়ার পর তাদের কেউই পুরো মজুরি পাননি।

এদিকে তৈরি পোশাকখাতের শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য কারখানা মালিকরা সরকারের কাছ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা নিয়েছিলেন। এরপরেও গত বছর লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক ছাঁটাই বা কর্মচ্যুতির শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডাব্লিউএস) হিসাবে, মহামারির শুরু থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে ছাঁটাই কিংবা কর্মচ্যুতির শিকার হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। এদের মধ্যে অনেকে তাদের বকেয়া বেতন বা ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। আর কাজে থাকা শ্রমিকদের মজুরি কাটা হয়েছে ব্যাপকহারে। বিসিডব্লিউএসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, মজুরি কর্তনের এই হার ৩৫ শতাংশ।

মেহজাবিন নামের এক পোশাক শ্রমিক জানান, ২০১৯ সালে বোনাস ও ওভারটাইম মিলিয়ে তিনি প্রতি মাসে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত পেতেন। অর্ডার বাতিলের কারণে কোনো ওভারটাইম করার সুযোগ নেই। এখন তার আয় নেমে এসেছে ১০ হাজার টাকায়। অন্য শ্রমিকদের অবস্থাও একইরকম। অনেকে বলছেন, গত বছর অচলাবস্থা চলাকালে তারা প্রত্যেকে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত মজুরি পেয়েছেন। আর ২০১৯ সালে ওভারটাইমসহ বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে যে আয় তারা করতেন, তা নেমে এসেছে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।

আবার অনেকের চাকরি না থাকায় কাজের খোঁজে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আরিফা নামের আরেক শ্রমিক জানান, এখন যা বেতন পাই তাতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই আয় দিয়ে সন্তানদের স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব না। কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাসাভাড়া কিংবা জিনিসত্রের দাম যে কমেনি, সেটা তারা ভাবছে না।

বিসিডাব্লিউএস জানায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতি ধনী শিল্প মালিকরাই গত বছরের প্রণোদনার অর্থ পেয়েছেন। মাসের পর মাস কারখানা বন্ধ রেখেও যাদের পক্ষে শ্রমিকদের বেতন দেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ছোট ও মাঝারি আকারের যে কারখানাগুলো বড় কারখানাগুলোর জন্য সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করে, তারা কোনো সহযোগিতা পায়নি। ফলে হয় তারা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, নয়তো উৎপাদন খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া গত বছর ৫০ শতাংশের বেশি সরবরাহকারী গড় দামের নিচে ক্রয়াদেশ নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ব্র্যান্ড ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। শ্রমিক অধিকারের প্রতি শিল্পমালিক ও ব্র্যান্ডগুলোর উদাসীনতা একইরকম। যার ফলে এই খাতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে লে-অফে পাঠানোর পাশাপাশি ব্যাপকহারে মজুরি কর্তনের ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ সূত্র জানায়, গতবছর প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বেশিরভাগ বড় কারখানাগুলো লাভবান হয়েছে। যেহেতু এই বিতরণের বিষয়টি নির্ভর করে রপ্তানির পরিমাণ ও ব্যাংক-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ওপর। দেশের ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের বেশিরভাগ বড় পরিসরের কারখানাগুলোতে কাজ করেন। তাই ছোট ও মাঝারি পরিসরের কারখানাগুলোর লে-অফ ঘোষণা এই খাতে বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি। ক্রেতারা বাংলাদেশকে এখনো পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে উৎস দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। তাই উন্নত ভবিষ্যতের জন্য এই খাতকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত।

এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে করোনা মহামারি। এ সময়টায় মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা দেখা গেলেও ভালো নেই পোশাক শ্রমিকরা। স্বাস্থ্যঝুঁকি মাথায় নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন কারখানার চাকা। পোশাক শ্রমিকরা বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের কাছে চাকরি হারানোর ভয়ই সবচেয়ে বড় ভয়। যদি আমরা আক্রান্ত হই, তাহলে আমরা নিশ্চিত যে আমাদের চাকরি চলে যাবে। আর যদি আমরা চাকরি হারাই, তাহলে কাছাকাছি সময়ে আমরা আর কোনো চাকরি পাব না। কারণ কোনো কারখানাই এখন নতুন কোনো শ্রমিক নিচ্ছে না।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’র (এমআইবি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ শতাংশের বেশি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। কোভিড মহামারি বিবেচনায় আরএমজি খাতে ক্ষতি, ক্ষমতা এবং পুনরুদ্ধার: মাঠ জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল’ শীর্ষক সমীক্ষাটি গত জানুয়ারিতে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, সংকট এতোটাই মারাত্মক যে, মাত্র ৪৪ শতাংশ কারখানা ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসের অর্ডার নিশ্চিত করতে পেরেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা ‘অনেক বেশি’ অনিশ্চয়তায় আছে। এমআইবি’র তিন হাজার ২১১টি নথিভুক্ত কারখানার মধ্যে ৬১০টি কারখানার ওপর এ জরিপ চালানো হয়। গতবছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৮৩ কর্মীর মধ্যে প্রায় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ জনের মতো চাকরি হারিয়েছেন। যা মোট শ্রমিকের প্রায় ১৪ শতাংশ। সিপিডি আরও জানায়, কর্মী ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মালিকই নিয়ম মানেননি। মাত্র তিন দশমিক ছয় শতাংশ কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনেছে। তারা বেতন ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং বকেয়া পরিশোধ করেছে। বেতন দিয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ কারখানা। মহামারির কারণে অনেক কারখানা ছোট হয়ে গেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একটি কারখানায় শ্রমিকের গড় সংখ্যা ছিল ৮৮৬। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তা ৭৯০ জনে নেমে এসেছে।

এদিকে করোনাকালে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি কমেছে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম আট হাজার টাকার মজুরি এখনো ২৩ শতাংশ শ্রমিক পায় না। তবে ওভারটাইম মিলিয়ে এ খাতের একজন শ্রমিকের বর্তমানে গড় আয় ১১ হাজার টাকার ওপরে। অন্যদিকে এখনও ৯০ শতাংশ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে রয়ে গেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেয়ার বাংলাদেশ এর এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত সোমবার এক বহু পরামর্শমূলক সভায় জরিপে প্রাপ্ত খসড়া তথ্য তুলে ধরা হয়।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিএস) এর সিনিয়র ফেলো মাহিন সুলতানের সঞ্চালনায় এ সময় সংসদ সদস্য শিরিন আক্তার ছাড়াও শ্রমিক ও বিভিন্ন এনজিও'র প্রতিনিধিরা খসড়া জরিপের ওপর তাদের মতামত তুলে ধরেন। সভায় জরিপে প্রাপ্ত খসড়া ফলাফল তুলে ধরেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজ আহমেদ।

চলতি বছর ৩৯০ জন গামেন্টস শ্রমিকের উপর জরিপের ভিত্তিতে আলোচ্য ফলাফল উঠে আসে। সভা শেষে আয়োজক কেয়ার বাংলাদেশ এর প্রতিনিধি বাবুল আজাদ জানান, জরিপ প্রতিবেদনটি চূড়ান্তভাবে উপস্থাপনের আগে এই সভার সুপারিশগুলোও প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। খসড়া জরিপ প্রতিবেদেনে বলা হয়, এখনো ২২ শতাংশের বেশি গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। এর বদলে অনেক কারখানা কেবল আইডি কার্ড দিচ্ছে। ১০ শতাংশ কারখানায় তাও দেওয়া হচ্ছে না। অথচ শ্রম আইন অনুযাযী, চাকরি শুরুর আগেই নিয়োগপত্র দেয়ার কথা। কিন্তু, যারা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাচ্ছেন, তাদেরও চাকরি শুরুর পর ক্ষেত্র-বিশেষে একবছর লেগে যাচ্ছে। কারখানায় নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের আলাদা আলাদা সার্ভিস বুক থাকতে হয় এবং এতে কোন তথ্য যুক্ত করতে হলে শ্রমিকের জানাতে হবে। কিন্তু, ৪০ শতাংশ শ্রমিক জানে না, সার্ভিস বুকে কী তথ্য রয়েছে এবং সেখানে যে তাদের স্বাক্ষর থাকতে হয়- তাও জানে না।

কর্মজীবী নারী সংস্থার সভাপতি প্রতিমা পল মজুমদার জানান, এতকিছুর মধ্যেও গত কয়েক বছরে আমাদের তৈরি পোশাক খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের সেরা ১০টি গ্রিন কারখানার বেশিরভাগই বাংলাদেশে। তিনি বলেন, রপ্তানি আদেশ বাড়লেও দাম পাচ্ছি না। পৃথিবীতে সব কিছুর দাম বেড়েছে, কিন্তু পোশাকের দাম বাড়েনি। এক্ষেত্রে, ট্রেড ইউনিয়নগুলো কিছু করতে পারে কিনা- সে বিষয়ে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি। কল্পনা আক্তার কোভিডকালে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরলেও তাদের জন্য কোন ধরনের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় নিজের হতাশার কথা জানান। তিনি বলেন, বর্তমান শ্রম আইন শ্রমিকের জন্য নয়, মালিকের জন্য হয়ে গেছে। এই আইন হতে হবে উভয়ের জন্য। আইএলও কনভেনশনের ১৯০ ধারা বাস্তবায়নের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত সময় আর আসবে না।

https://dailysangram.com/post/456557