২৪ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:০২

ঢাকার সঙ্গে বাস ট্রেন লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ

ঢিলেঢালা লকডাউনে ভোগান্তির যাত্রা

বিধিনিষেধ না মানলে পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা -ডা. রোবেদ আমিন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় দেওয়া লকডাউন চলছে ঢিলেঢালাভাবে। এসব জেলায় বেসরকারি অফিস ও কলকারখানা চালু থাকায় ঘরের বাইরে আসছে কর্মজীবী মানুষ।

বিভিন্ন সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেখা গেছে। দোকানপাট খোলা রেখেই চলছে বেচাকেনা। পাড়া-মহল্লার অলিগলির চা দোকানে চলছে আড্ডা। নানা অজুহাতে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আসছেন।

এছাড়া অনেককেই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করতে দেখা গেছে। ফেরিঘাটে মানুষের ভিড় বাড়ছে। পণ্যবাহী যানবাহন পারাপারের কথা থাকলেও মানুষ জোর করে ফেরিতে উঠে পড়ছে। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় দূরের যাত্রীরা ভেঙে ভেঙে যানবাহন পালটে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। ফলে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। সদরঘাট থেকে যাত্রীবাহী কোনো নৌযান ছেড়ে যায়নি।

টার্মিনাল ছিল ফাঁকা। ট্রেন বন্ধ থাকায় যাত্রীশূন্য ছিল প্ল্যাটফরম। তবে কমলাপুরসহ বিভিন্ন স্টেশন থেকে যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এজন্য বুধবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কাউন্টারের সামনে যাত্রীদের লম্বা লাইন দেখা গেছে।

স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ না মানলে চলমান করোনা পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে যেতে পারে। অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বুধবার এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। পজিটিভিটির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকার চারপাশে কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা আপাতত ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাত জেলার সংক্রমণ পরিস্থিতি দেখছি। যদি সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি এবং ঢাকার পরিস্থিতি নাজুক হয়, তা হলে শুরুতে ঢাকাকে লকডাউনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

করোনা সংক্রমণ থেকে রাজধানীকে রক্ষা করতে হঠাৎ সোমবার মধ্যরাত থেকে ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়। মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ জেলা এর আওতায় পড়ে।

এরপর থেকেই ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার বাস, লঞ্চ ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ এ ধরনের সিদ্ধান্তে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। এসব জেলায় বিধিনিষেধ জারির দুদিন পরও করোনা সংক্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরে সোমবার সংক্রমণের হার ছিল ১৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, বর্তমানে তা বেড়ে ২০ দশমিক ৪৭-এ দাঁড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নারায়গঞ্জে শনাক্তের হার ১০.০৪ ভাগ। সোমবার এ হার ছিল ৮.১৫ শতাংশ।

লকডাউনের দ্বিতীয় দিন বুধবারও ঢাকার প্রবেশমুখগুলোয় মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ করা গেছে। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য এদিনও অনেক মানুষ সাইনবোর্ড, সায়েদাবাদ, গাবতলী, আবদুল্লাহপুরসহ নগরীর প্রবেশমুখে জমা হয়েছেন।

একইভাবে বাইরে থেকে ঢাকায় প্রবেশের জন্যও অনেককে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। উভয় পথেই বড় গাড়ি না থাকায় অনেকেই ছোট ছোট গড়ি, ছোট-বড় ট্রাক, মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ নানা ধরনের যানবাহনে উঠে বসেছেন। এসব বাহনে কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসতে দেখা যায়নি। কারও কারও মুখে মাস্কও ছিল না।

এছাড়া যাত্রীদের গুনতে হয়েছে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া। তাও আবার অনেকেই এ ধরনের বাহনে উঠতে পারেননি। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্ক বাবা-মাকে নিয়ে যারা বের হয়েছেন তাদের বেশি কষ্ট করতে হয়েছে।

বাইরের জেলাগুলোয় উন্নত চিকিৎসাসেবা না থাকায় করোনাসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীকে ঢাকায় আনার প্রয়োজন। কিন্তু যানবাহন বন্ধ থাকায় অনেকেই আসতে পারছেন না। যারা আসছেন, তাদের সীমাহীন কষ্ট করতে হচ্ছে। ধনীরা অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কারে আসতে পারলেও দরিদ্র মানুষ সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

শ্রমজীবী মানুষও চলাচলে মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, করোনার ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় জেলাভিত্তিক লকডাউন সরকারের ভালো উদ্যোগ ছিল। সরকারের সেখান থেকে হঠাৎ করে দূরপাল্লার গণপরিবহণ বন্ধ করে দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। সরকারকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো খুবই অপরিপক্ব বলে মনে করছেন। এখানে সরকারের দেউলিয়াপনার চিত্র ফুটে উঠছে।

সরেজমিন বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহণ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সকাল থেকে সড়কে বাসের সংখ্যা ছিল কম। কোথাও কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে গাড়ি পাননি। এতে বিপাকে পড়েন অফিসগামীরা। এ ছাড়া যারা জরুরি প্রয়োজনে বেরিয়েছেন, তাদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সীমাহীন।

নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া থেকে যারা নিয়মিত বাসে ঢাকায় যাতায়াত করেন, তাদের মারাত্মক বিপাকে পড়তে দেখা গেছে। বাস চলাচল না করায় বিকল্প যানে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়েছে। সেখানে এসেও বাস না পেয়ে অনেককে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

উত্তরার আবদুল্লাহপুর এলাকায় সকাল ৮টায় বাসের অপেক্ষায় যাত্রীদের দীর্ঘলাইন দেখা গেছে। আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করেও অনেকে বাসে উঠতে পারেননি। অনেকক্ষণ পরপর যাও একটা বাস আসছে, তাদের উঠতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে অফিসগামীদের। যারা বাসে সুযোগ পেয়েছেন, তারা অনেকে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গন্তব্যে পৌঁছেছেন।

সিটের দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে কোনো কোনো বাসে। আন্তঃজেলার বাস চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের শুধু ঢাকার বাসের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। যাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা কম হওয়ায় চাপ বেশি ছিল। একটি বাস থামলেই তাতে হুড়োহুড়ি করে উঠতে দেখা যায় যাত্রীদের। এমন অবস্থায় চাকরিজীবী নারী ও অসুস্থদের চরম বিপাকে পড়তে দেখা গেছে।

টঙ্গীর বাসিন্দা মো. তারিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, স্ত্রীর চাকরির কারণে তাকে টঙ্গীতে বাসা নিতে হয়েছে। আর তার অফিস কুড়িল। গাজীপুরে লকডাউন চলছে, আর দূরপাল্লার বাস বন্ধ। পাশাপাশি অটোরিকশাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও তার অফিস চলছে। এজন্য প্রতিদিন তাকে অফিসে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তিনি বলেন- হেঁটে, ট্রাকে চড়ে, মোটর বাইকে চড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাকে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে সীমাহীন জনদুর্ভোগের পাশাপাশি অনেক বেশি টাকাও খরচ হচ্ছে।

বছিলার গৃহবধূ বিলকিছ খাতুন যুগান্তরকে বলেন, সোমবার দুপুরে তার খালার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ৫ বছরের মেয়ে ও ৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে বাসে চড়ে পাবনা গেছেন। হঠাৎ করে বাস বন্ধ করে দেওয়ায় এখন ঢাকায় ফিরতে পারছেন না তিনি। এ গৃহবধূ বলেন, এক-দুদিন আগে গণপরিবহণ বন্ধের ঘোষণা দিলে তিনি ঢাকায় ফিরে আসতে পারতেন। তার মতো, এমন আরও অনেক মানুষও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিরা জানান, ঢাকার আশপাশের ৭ জেলায় বুধবার ঢিলেঢালাভাবে লকডাউন পালিত হয়েছে। এদিন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ১৪ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে।

রাজবাড়ী : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার হিসাবে খ্যাত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে ফেরিতে বেড়েছে ঢাকামুখী ও ঢাকা ফেরত যাত্রীদের চাপ। দৌলতদিয়া ৫ নম্বর ফেরিঘাটে বুধবার সকালে এ চিত্র দেখা যায়।

মাগুরা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নিয়ে আসা চালক অনিম বলেন, গাড়িতে থাকা রোগী ব্রেনস্ট্রোক করেছে। তাকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দৌলতদিয়া ঘাটে ভোরে পৌঁছালেও ফেরির টিকেট দেরিতে দেওয়ায় বিড়ম্বনার শিকার হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জে কোনো বিধিনিষেধ মানছে না মানুষ। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলাচল করছে যাত্রী ও যানবাহন। ঢাকার সঙ্গে বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকলেও জেলায় চলছে গণপরিবহণ। খোলা রয়েছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

কালিয়াকৈর (গাজীপুর) : গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দ্বিতীয় দিনেও ঢিলেঢালাভাবে চলছে লকডাউন। লকডাউন উপেক্ষা করে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে মানুষ। উপজেলার অধিকাংশ এলাকাতেই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব কোনোটাই মানা হচ্ছে না। মার্কেট, রাস্তা ও বাজারে অবাধে চলাচল করছে মানুষ।

কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ) : গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে ১৪ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সরকার ঘোষিত বিভিন্ন নির্দেশনা না মেনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসএম মাহফুজুর রহমান। এ সময় তিনি ১৪টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ১৫ হাজার ৬শ টাকা জরিমানা করেন।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/435052/