২০ জুন ২০২১, রবিবার, ১২:৪০

বাংলাদেশে টিকার স্টক? লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার : শুমার করিয়া দেখে

আজ মূল বিষয়ে যাবার আগে ছোটো খাটো দুই একটি খবরের প্রতি সম্মানিত পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এই ধরনের খবর হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত জ্বলে উঠেই নিভে যায়। অথচ খবরগুলি আমার আপনার মত সাধারণ মানুষের জন্য আশা জাগানিয়া। খবরগুলি প্রকাশিত হওয়ার পর সেগুলো নিয়ে আর পারসু করা বা ফলোআপ করা হয় না। প্রথমে খবরগুলির ওপর চোখ বুলানো যাক।

প্রথম খবরটি বাংলাদেশের এক শ্রেণির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ১২ জুন। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স পরিবেশিত সংবাদের শিরোনাম, “করোনা চিকিৎসায় নতুন এন্টিবডি? ১২ ঘন্টায় সুস্থ ২ রোগী”। খবরে বলা হয়েছে, “করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারতের চিকিৎসকরা এই এন্টিবডি থেরাপি বের করেছেন। করোনা ভাইরাস চিকিৎসায় নতুন একটি এন্টিবডি থেরাপি ব্যবহার করে দারুণ ফল পেয়েছেন ভারতের চিকিৎসকরা। করোনা উপসর্গের প্রথম ৭ দিনের মধ্যে দুই রোগীর শরীরে মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগের ১২ ঘন্টার মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন তারা। ১১ জুন ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআই এক রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে।”

ঐ রিপোর্টে বলা হয়, নয়াদিল্লীর স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে নতুন ঐ এন্টিবডি থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। থেরাপি নেয়া দুজনের মধ্যে একজন স্বাস্থ্যকর্মী। তার বয়স ৩৬ বছর। তবে তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। অন্যজনের নাম আর কে রাজদান। তার বয়স ৮০ বছর। তিনি ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন।

হাসপাতালের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রচন্ড জ্বর, কাশি ও দুর্বলতাসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন ৩৬ বছর বয়সী ঐ স্বাস্থ্যকর্মী। উপসর্গ দেখা দেয়ার ষষ্ঠ দিনে তার শরীরে মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগ করা হয়। এই এন্টিবডি দেয়ার ১২ ঘন্টার মধ্যে তার অবস্থার উন্নতি হয় এবং হাসপাতাল থেকে তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়।

অপর রোগী আর কে রাজদানের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রচন্ড জ্বর ও কাশি ছিল। তার অক্সিজেনের মাত্রা ছিল ৯৫ শতাংশের বেশি। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার অবস্থা মাঝারি পর্যায়ে। উপসর্গের পঞ্চম দিনে তাকেও মনোক্লোনাল দেয়া হয়। পরবর্তী ১২ ঘন্টার মধ্যে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং হাসপাতাল থেকে তিনিও ছাড়পত্র পান।

স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্ট (মেডিসিন বিভাগ) পূজা খোসলা বলেছেন, উপযুক্ত সময়ের মধ্যে রোগীর দেহে মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগ করা হলে তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। অন্য রোগে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মত খারাপ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারে এই এন্টিবডি। পাশাপাশি রোগের অবনতিও রোধ করা সম্ভব। এছাড়া এটা করোনা চিকিৎসায় স্টেরয়েড ও ইমিউনোমডিউলেশন ব্যবহার কমানোয় সাহায্য করতে পারে। বর্তমানে করোনা রোগীদের শরীরের স্টেরয়েড ব্যবহারে ভারতের ফাঙ্গাসের মত বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

॥ দুই ॥
এই খবরের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে আমাদের মনে কোনো রকম সন্দেহ বা খটকা নাই। আমরা চিকিৎসকও নই বা চিকিৎসা বিজ্ঞানীও নই। তাই আমাদের মনে একটি খটকা থেকে যায়। সেটি হলো, করোনাতে ধন্বন্তরির মত কাজ করে, এমন ওষুধ বা থেরাপি গণহারে ব্যবহার করা হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশের যারা ভারতে, বিশেষ করে কলকাতা, দিল্লী বা চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যান তারা স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালের নাম ডাক শুনেছেন। এই হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধানের বরাত দিয়ে খবরটি পরিবেশিত হয়েছে। সুতরাং খবরটির সত্যতা এবং অথেনটিসিটি কোনোটাই প্রশ্ন সাপেক্ষ নয়। দুর্গত মানবতার সেবার জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন এবং এ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেন। তারা যদি এর কার্যকারিতা সম্পর্কে কনভিন্সড হন তাহলে বাংলাদেশে মনোক্লোনাল এন্টিবডি থেরাপির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা যেতে পারে।

এবার আসছি দ্বিতীয় সংবাদে। ঢাকারই একটি দৈনিকে গত ১৩ জুন একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটির শিরোনাম ছিল, “কলকাতার বিজ্ঞানীর পকেট ভেন্টিলেটর সাড়া ফেলেছে বিশ্বে”। খবরে বলা হয়, “তিনি নিজেই হয়েছিলেন করোনায় আক্রান্ত। রক্তে অক্সিজেন লেভেল নেমে গিয়েছিল ৮৮ শতাংশে। হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন না হলেও করোনাকালে ভেন্টিলেটরের গুরুত্ব তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। করোনা মুক্ত হয়ে মাত্র ২০ দিনেই তিনি করোনা রোগীদের জন্য তৈরী করলেন বিশেষ পকেট ভেন্টিলেটর। তিনি কলকাতার বিজ্ঞানী ড. রামেন্দ্রলাল মুখোপধ্যায়। করোনা মহামারির এই সংকটময় মুহূর্তে তার এই পকেট ভেন্টিলেটর আবিষ্কার সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছে।” এই খবর দিয়েছে ‘ইন্ডিয়া টুডে’।

ড. রামেন্দ্রলালের ভেন্টিলেটরটি ব্যাটারী চালিত। এটি যে কোনো রোগীকে তাৎক্ষণিক সাহায্য দিতে পারে। হঠাৎ করে কারও অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করলে কয়েক দিন এই ভেন্টিলেটর দিয়ে সংকটময় মুহূর্ত পার করা যাবে। ২৫০ গ্রাম ওজনের এই ভেন্টিলেটর একবার চার্জ দিলে ৮ ঘন্টা চলে। সাধারণ মোবাইল চার্জারের মাধ্যমে এটি সহজেই চার্জ দেয়া যায়। যেহেতু এটি হ্যান্ডি, তাই যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাওয়া বা পরিবহনেও কোনো সমস্যা নাই।

এই পকেট ভেন্টিলেটরের দুটি অংশ রয়েছে। একটি পাওয়ার ইউনিট। অন্যটি মাউথপিস সহ ভেন্টিলেটর ইউনিট। দুটো ইউনিট যুক্ত থাকে মুখোশের সাথে। ভেন্টিলেটরের সুইচ অন করার সাথে সাথে বাইরের বাতাস ভেন্টিলেটরে মওজুদ থাকা আল্ট্রা ভায়োলেট চেম্বার দিয়ে বিশুদ্ধ হয়ে ফুসফুসে যায়। চেম্বারের মধ্যে জিবাণু থাকলেও সেটিও মরে যায়। আবার রোগী যখন নিঃশ্বাস ছাড়ে তখন একই ভাবে এই পকেট ভেন্টিলেটর বাতাসকে আল্ট্রা ভায়োলেট শুদ্ধ করে ছাড়ে। এর ফলে আশে পাশে থাকা মানুষ অথবা ডাক্তার নার্সদের কোনো ক্ষতি হয় না। এই পকেট ভেন্টিলেটর হাসপাতালে ব্যবহৃত কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার মেশিনের বিকল্প হিসাবে কাজ করে।

॥ তিন ॥
মনোক্লোনাল এন্টিবডি সম্পর্কে মন্তব্য করা যত সহজ ছিল এই পকেট ভেন্টিলেটর সম্পর্কে মন্তব্য করা তত সহজ নয়। কারণ মনোক্লোনাল দিল্লীর একটি বড় এবং নাম করা হাসপাতালে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং রোগী সুস্থ হওয়ার খবর রয়টার্সের মত বিশ্ববিখ্যাত বার্তা সংস্থা পরিবেশন করেছে। কিন্তু এই পকেট ভেন্টিলেটর দিল্লী বা চেন্নাইয়ের বিখ্যাত হাসপাতালগুলো তো পরের কথা, আমাদের পাশের প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতার কোনো হাসপাতালে প্রয়োগের খবর বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায় আমি দেখি নাই। তাই বলে এটির আবিষ্কারের খবরকে আমি কেনো অংশেই খাটো করছি না। কলকাতার ঐ বিজ্ঞানী ঐ পকেট ভেন্টিলেটর আবিষ্কারের পর সেটি বাজারজাত করা বা গণহারে প্রয়োগ করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন সেগুলি আমাদের জানা দরকার। এই পকেট ভেন্টিলেটর যদি সত্যিই কার্যকর হয় তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ বাংলাদেশে আইসিইউ বেড এবং অক্সিজেনের জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। মিডিয়া রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে মফস্বলের ৬০ শতাংশ হাসপাতালেই অক্সিজেন সাপোর্টের ব্যবস্থা নাই। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ শয্যা বা আইসিইউ বেড নাই। আমেরিকা ভারতে ১ হাজার ভেন্টিলেটর পাঠিয়েছে। বাংলাদেশকে কেউ পাঠায় নাই। এই পটভূমিতে ড. রামেন্দ্রলালের পকেট ভেন্টিলেটরের ব্যাপারে বাংলাদেশের উচিত, আরো বেশি করে খোঁজ খবর নেয়া।

॥ চার ॥
তৃতীয় খবর হলো, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বেলজিয়ামের জনসন এ্যান্ড জনসনের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে গত মঙ্গলবার ১৫ জুন। এটি একটি ভাল খবর। এই নিয়ে সরকার ৬টি টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিল। এগুলি হচ্ছে, আমেরিকার ফাইজার বায়ো এনটেক, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকা (ভারতের সেরামে প্রস্তুত কোভিশিল্ড), রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি, চীনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম নামক দুই কোম্পানীর দুই টিকা এবং সর্বশেষ জনসন এ্যান্ড জনসনের জ্যানসেন। এই ৬টি কোম্পানীর টিকার মধ্যে ৫টিই হলো ডাবল ডোজের টিকা। শুধুমাত্র জনসন এ্যান্ড জনসনেরটি সিঙ্গেল ডোজের টিকা।

টিকার ব্যাপারে একটির পর একটির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু টিকার ভান্ডার? সেই ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার। শুমার করিয়া দেখে চব্বিশো হাজারের’ মত। আমাদের রাষ্ট্রীয় ভান্ডারের মওজুদ চীনের খয়রাতি ১১ লক্ষ, আর কোভ্যাক্সের খয়রাতি ১ লাখ ফাইজারের টিকা। মোট ১২ লাখ। প্রয়োজন ১৩ কোটি। এরমধ্যে এ্যাস্ট্রাজেনেকার এক ডোজ নিয়ে সেকেন্ড ডোজের জন্য ঝুলে আছেন ১৫ লাখ মানুষ।
আগে বলা হয়েছিল যে মে মাসের মধ্যে রাশিয়ার টিকা আসবে। অথচ আজ পর্যন্ত রাশিয়ার সাথে চুক্তিই সই হয় নাই। চীনের সাথে সই হলো মাত্র সেদিন। কি করল এতদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো সব দোষ দিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/456093