ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে বাড়তি ঋণ গ্রহণে ব্যয় ও সুদ হার বাড়ছে। একদিকে দেশে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রাও হারাচ্ছে সরকার। বাড়ছে বেকারত্বের হার। এ বছর সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। একইভাবে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। উচ্চ হারের এসব ঋণের কারণে বাড়ছে বাজেট ব্যয়। আর এ ঋণের দায় চাপছে জনগণের ঘাড়ে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্বণর ফজলে কবির বলেছেন,অভ্যন্তরিণ খাত থেকে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা গ্রহন করলেও তাতে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন।সরকারের মেগা প্রকল্প ছাড়া দেশে বড় ধরনের কোন বিনিয়োগ নেই। যা কর্মসংস্থানে বাধা সৃষ্টি করছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি রাখা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। তবে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা নেয়া হলেও এর প্রভাব ব্যাংক খাতে পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে ৯২ দশমিক ৪২ শতাংশ। বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিলবন্ডে বিনিয়োগ হলেও এখনও ৪০ হাজার কোটি টাকার তারল্য রয়েছে। গত শুক্রবার বাজেটোত্তর অনলাইন সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার তাৎক্ষণিক বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব কম সুদে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের প্রচেষ্টা নেয়ার অনুরোধ জানাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিলবন্ডে বিনিয়োগ হলেও এখনও অনেক টাকা ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ২০২ কোটি টাকা।
আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছিল ৪০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। করোনার মধ্যেই আমানত বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের শুরুতে ব্যাংক খাত থেকে সরকার যে পরিমাণ ধার করেছিল, তার চেয়ে বেশি পুরোনো ধারের টাকা পরিশোধ করেছে। তবে অর্থবছরের শেষের দিকে এসে ঋণ নেওয়া শুরু করেছে সরকার। ফলে গত ২০ মে পর্যন্ত সরকারের প্রকৃত ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। পরে তা সংশোধন করে ৮২ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
জানা যায়, করোনার কারণে মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে যেমন তারল্য বাড়ছে, একইভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও হু হু করে বেড়েছে। আর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের তারল্য সংস্থান হওয়ায় সরকারও সেভাবে ব্যাংকঋণমুখী হচ্ছে না। ফলে ২০ মে পর্যন্ত ব্যাংক থেকে অর্থবছরের লক্ষ্যের ৫ শতাংশ অর্থও নেয়নি সরকার। আর করোনায় বেসরকারি ও সরকারি-উভয় খাত ব্যাংকঋণ-নির্ভরতা কমিয়ে দেওয়ার ব্যাংকগুলো অলস তারল্য নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নতুন অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের লক্ষ্য আরও কমিয়ে আনছে সরকার। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে তা কমিয়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা করা হতে পারে। আর সঞ্চয়পত্রে চলতি অর্থবছর ২০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মার্চ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৩৩ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের লক্ষ্য আরও বাড়ানো হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকার ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণ স্থিতির মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। বাকি ১৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা ধার নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
বাজেটে মোটা দাগে ব্যয় বাড়লেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য করোনা মোকাবেলায় কোন প্রনোদণা রাখা হয়নি। এতে করে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। করোনার কারনে নতুন কোন বড় ধরনের বিনিয়োগের সম্ভাবনাও নেই। এতে করে বেকারত্বের পরিমানও বাড়বে। যা দেশের আইন শৃঙখলার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বেড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ব্যাংকে সুদহার কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহ বেড়েছে সাধারণ মানুষের। এছাড়া মূলধন নিশ্চিত ও বেশি মুনাফা পাওয়ায় সঞ্চয়পত্রকেই সবচেয়ে বেশি ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ মনে করেন তারা। তাই সঞ্চয়পত্র কেনায় ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার তার চেয়ে প্রায় ৭৪ শতাংশ এবং সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছে। অর্থবছরের বাজেটে যার লক্ষ্য ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সংশোধন করে তা বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে সবচেয়ে বেশি ‘নিরাপদ’ মনে করছেন। তাই বিভিন্ন শর্ত পরিপালন করেও বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল, তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানুয়ারির তথ্য বলছে, বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতের বিপরীতে ৩ থেকে ৬ শতাংশ সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে সুদ মিলছে ১১ শতাংশের ওপরে।
সঞ্চয় অধিদফতরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৯১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এ সময়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ও মূল টাকা পরিশোধ হয়েছে ৫৭ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে এ সময় নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৭২৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
একক মাস হিসেবে চলতি বছরের এপ্রিলে মোট ৫ হাজার ৮৮৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মূল অর্থ পরিশোধ হয়েছে ৪ হাজার ৩৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এপ্রিলে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। বিক্রির ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এর বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
জাতীয় বাজেটে ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎসাহের মধ্যে অন্যতম সঞ্চয়পত্র। সবশেষ গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাজেটের আয়-ব্যয়ের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। এছাড়া এবারের বাজেটে দুই লাখ টাকার কম সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস কিনতে হলে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) লাগবে না। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়েছিল। ওই সুদহারই এখন পর্যন্ত বহাল আছে।
বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
জানা গেছে,অভ্যন্তরিণ ঋণ পরিশোধে ঘোষিত বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছে ৬,৫৮৯ কোটি টাকা। এ দুই খাতে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে ৬৮,৫৮৯ কোটি টাকা। যা বাজেটের ১৮.৭ শতাংশ। মূলত অভ্যন্তরিন খাত থেকে ঋণ নেয়ার কারনেই ঋণের বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের বড় ধরনের কোন বিনিয়োগ হচ্ছে না। আর এ কারণেই দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। অন্যদিকে বাজেট ব্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয়। আর এতে করে নতুন করে দারিদ্রের পরিমানও বাড়ছে।