২৭ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার, ২:৩৯

করোনার কারণে সুযোগ সৃষ্টি হয়নি নতুন কর্মসংস্থানের

সরাসরি নিয়োগ ও অবকাঠামো খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু কর্মসৃজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর স্থবিরতায় অর্থবছরের ১০ মাসে এডিপির অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়নি। এই মহামারির বছরে পুরো হিসাবই উল্টে গেছে। ই-কমার্সখাত ছাড়া অন্যান্য খাতে নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া করোনার কারণে সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়াও ঝুলে রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ যুবক কাজের বাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ১২-১৩ লাখ কর্মসংস্থান হয় সরকারি ও বেসরকারি খাতে। ৫-৭ লাখ মানুষ কাজ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পরও বেকার থাকেন প্রায় দুই লাখ। কিন্তু এই মহামারির বছরে পুরো হিসাবই উল্টে গেছে। বিদেশে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমার পাশাপাশি ফেরত আসা শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে দেশে বেসরকারি ও বিদেশী উৎস থেকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়, এবার তাও হয়নি। ফলে ই-কমার্সখাত ছাড়া অন্যান্য খাতে নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর শুরু হওয়া প্রথম লকডাউনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে পাঁচ কোটির বেশি কর্মীর জীবন-জীবিকা লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার আড়াই মাসের মাথায় বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল করোনার কারণে মাত্র ১৪ লাখ মানুষ কাজ হারাতে পারেন বলে আশঙ্কার কথা জানান। অবশ্য এর আগেই একাধিক গবেষণা সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, করোনার কারণে দুই কোটির বেশি মানুষ কাজ হারাতে পারে, তাতে নতুন করে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যবরণ করবে। ৬৬ দিনের প্রথম দফা লকডাউনে ২.৪৩ কোটি নতুন বেকার হওয়ার তথ্য বাজেট ঘোষণার চার মাসের মাথায় জানায় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, এবং সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে বেসরকারিখাত কর্মী ছাঁটাই করবে না- এমন অনুমান করে বাজেট প্রণয়ন করায় তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। আয়ের উৎস হারানোর বড় সমস্যাকে ছোট করে দেখে চলতি অর্থবছরের বাজেটে দেশে কাজ হারা ও বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ২০০০ কোটি টাকা। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) ৫০০ কোটি টাকা করে বরাদ্দের শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারেনি কয়েকটি সংস্থা। অর্থবছরের মাঝপথে এসে আরও আটটি সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করে প্রান্তিক পর্যায়ে জনগোষ্ঠীর মাঝে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র ৫৩০ কোটি টাকা। এর বাইরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে চার লাখের বেশি মানুষের সারা বছরের কাজের ব্যবস্থার কথা বলা হলেও বছরের ১০ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর অর্ধেকেরও কম বাস্তবায়ন হওয়ায় এ লক্ষ্যও অর্জন হয়নি। আর এই সময়ে সরকারি খাতে জনবল নিয়োগও এক প্রকার স্থবির হয়ে আছে।

গত বছরের শেষ প্রান্তিকে দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর করপোরেট জব পোস্টিং মহামারির আগের অবস্থায় পৌঁছেছিল বলে জানান বিডিজবস ডট কমের সিইও একেএম ফাহিম মাসরুর। তিনি জানান, করোনার সেকেন্ড ওয়েভে তা আবার অর্ধেকে নেমে এসেছে।

একই অবস্থা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও। করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশ হচ্ছিল, ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পরীক্ষাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেকেন্ড ওয়েভের কারণে সেসব নিয়োগও আটকে গেছে। ফলে প্রতিবছর সরকারি-বেসরকারিখাতে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, এবার তা হয়নি।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলছে, প্রথম দফা লকডাউনে কর্ম হারানোদের বড় অংশ পরে কম মজুরিতে হলেও কাজ ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু সেকেন্ড ওয়েভে গত ৫ মে থেকে শুরু হওয়া চলমান লকডাউনে তাদের অনেকে আবারও কাজ হারিয়েছেন। অনেকে আবার পরিবারসহ রাজধানী ছাড়ছেন।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছর দেশে ১৪.৩ লাখ ও দেশের বাইরে ৫.৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অর্জন করা বর্তমান বাস্তবতায় অসম্ভব বলে মনে করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম। তিনি জানান, মোট দেশজ উৎপাদনে ৭.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এবার দেশে ও বিদেশে ২০.১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে বেসরকারি খাতে এবার বিনিয়োগ ও উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কম হবে। তাই প্রত্যাশিতহারে কর্মসংস্থানও হবে না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান জানান, এটা বাস্তবতা যে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছেন। তবে কর্মসংস্থান রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার ব্যবস্থা হলেও নতুন কর্মসৃজনের ব্যবস্থা চলতি বছরের বাজেটে ছিল না। পোশাক খাতে কর্ম ধরে রাখতে কর্মীদের বেতন হিসেবে প্রণোদনা দেয়া হলেও সব কারখানা ও শ্রমিক এ সুবিধা পায়নি। তা ছাড়া প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানও কর্মী ছাঁটাই করেছে। আগামী বাজেটে কর্মসৃজনে প্রাধান্য দিয়ে বড় বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকে ব্যক্তিখাতের। করোনার আঘাতে ব্যক্তিখাত বিশেষ করে শ্রমনির্ভর কুটির, অতিক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে বেশি ক্ষতি হওয়ায় কর্মসংস্থান কমেছে বলেও তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, রপ্তানি আয়, শিল্প উৎপাদন, বেসরকারি ঋণপ্রবাহ, মেয়াদী ঋণ বিতরণ, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আহরণের তথ্য পর্যালোচনা করলেও সহজেই বলা যায় যে, ব্যক্তিখাতে কাজের পরিমাণ কমেছে।

https://dailysangram.com/post/453581