২৬ মে ২০২১, বুধবার, ২:৩২

এই দুঃসময়ে পানির দাম বাড়াল ওয়াসা

আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা, যা কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। গত সোমবার ওয়াসার বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে অংশ নেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, দাম বাড়ানোর পর আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম দাঁড়াবে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বর্তমানে ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করে দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন দাম কার্যকর হলে বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম দিতে হবে ৪২ টাকা। যা আগে দিতে হত ৪০ টাকা। এবার পানির দাম বাড়ানোর ফলে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সময়ে ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়ানোর ঘটনা ঘটলো।

কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা ওয়াসার এক হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ২৮ টাকা। আর আবাসিক ও বাণিজ্যিক আয়ের মধ্যে বাণিজ্যিক আয়ের হার ৭ শতাংশ। সে কারণে পানির মূল্যবৃদ্ধি করা দরকার ছিল। এ ছাড়াও মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ সমন্বয় করতেও মূল্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ওয়াসা আইন ১৯৯৬-এর ২২(২) ধারা অনুযায়ী ওয়াসা বোর্ড অনধিক ৫ শতাংশ হারে পানি ও পয়ঃঅভিকর সমন্বয় করতে পারে। জ্বালানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের প্রক্রিয়া থাকলেও পানির ক্ষেত্রে তা নেই।

এ প্রসঙ্গে বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, সার্বিক ব্যয় পরিচালনা ও মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করতে পানির দাম বাড়ানোর এ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক মঙ্গল কামনায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে বোর্ড। কেননা, নগরবাসীর জন্য সুপেয় পানি সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে তো অর্থের সংস্থান প্রয়োজন রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বি আইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, এখন করোনা মহামারী চলছে, এ অবস্থায় পানির দাম বাড়ানোর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য পীড়াদায়ক হবে। এ সময় পানির দাম না বাড়ালে ভালো হতো। তবে মূল্যস্ফীতির সমন্বয় ও প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনে করা হলে এটাকে প্রয়োজন বলতে হবে। তবে সেটি কিছুদিন পরে করা যতে।

ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় বলেন, পানির উৎপাদন খরচ এবং পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাওয়াতেই এ দাম বাড়াতে হয়েছে। আমরা সব সময় মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনায় রাখি। এর নিরিখেই দাম বাড়ানো হয়েছে।

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ওয়াসার পরিচালনা বোর্ড তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে পানির দাম বাড়ায়। ওয়াসার অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং পানির মান বৃদ্ধি না করেই তা করা হচ্ছে। এটা ভোক্তাদের ঘাড়ে বোঝা হিসেবে চাপে।’ গোলাম রহমান বলেন, অব্যবস্থাপনা কমালে, দুর্নীতি কমালে পানির দাম এভাবে বাড়াতে হবে হতো না।

সূত্র মতে, পানির দাম বাড়ানোর এ প্রস্তাব গত মার্চ মাসে দিয়েছিলেন ওয়াসার আলোচিত-সমালোচিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। পরে অবশ্য করোনাকালে পানির দাম বাড়ানো নিয়ে সমালোচনার তোপে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ঢাকা ওয়াসা। করোনার শুরুর দিকে গত বছরের এপ্রিলেও এক দফা পানির দাম বাড়িয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। সে সময় প্রতি ইউনিটে দাম বাড়ানো হয়েছিল ২ টাকা ৮৯ পয়সা। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে যখন করোনা ফের খারাপ রূপ ধারণ করছে, সেসময়ে এসে সোমবারের বোর্ড সভায় ফের পানির দাম বাড়িয়ে দিল ওয়াসা।

ওয়াসার পানির মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ওয়াসা আইন ১৯৯৬ অনুযায়ী, বাৎসরিক সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু করোনাকালে এমনিতেই অসহায় অবস্থায় আছে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে পানির দাম বাড়ানো আসলেই অমানবিক। এতে করে করোনাকালে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবে ওয়াসার প্রতি। পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধের অজুহাতে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক খাতে ঢাকা ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক, গ্রাহকের ওপর এক ধরনের চাপিয়ে দেওয়া নির্যাতনমূলক ব্যাপার এটি।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, সোমবারের ওয়াসার বোর্ড সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে অংশ নেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। ওয়াসার বোর্ড সভার সদস্য ১৩ জনের মধ্যে কয়েকজন মত দেন যে, সার্বিক বিবেচনায় এখনই পানির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। কিন্তু পানির দাম বাড়াতে শুরু থেকেই তাকসিম সবচেয়ে তৎপর ছিলেন। আইন অনুযায়ী প্রতিবছর পানির দাম বাড়ানো যায় এবং দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়াতে হবে এমন সব যুক্তিতে পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। জানা গেছে, শারীরিক চিকিৎসা এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কারণ দেখিয়ে তিন মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। গত ২৫ এপ্রিল হতে ২৪ জুলাই পর্যন্ত অথবা যাত্রার তারিখ হতে তিনমাস (প্লাস ট্রানজিট) মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালীন সেখান থেকেই ভার্চুয়ালি অফিস করছেন তিনি। গত ১২ এপ্রিল নিজের স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তিনি নিজেই উল্লেখ করেন, আমার শারীরিক চিকিৎসা করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কারণে ২৫ এপ্রিল থেকে ২৪ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত অথবা যাত্রার তারিখ থেকে তিনমাস (প্লাস ট্রানজিট) মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করব। অফিসে আদেশে তিনি বলেন, দেশের বাইরে অবস্থান কালে আমি নিজে যেকোনো পলিসি এবং অন্যান্য বিষয়ে ই-নথি, ই-জিপি, ই-মেইল, ফেস টাইম, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করব। এ সময় ঢাকা ওয়াসা স্ব স্ব উইং প্রধানগণ তাদের নিজ নিজ উইং এর রুটিং কার্যাদি সম্পাদন করবেন এবং সার্বক্ষণিক আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন। অফিস আদেশে তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই সময়ে কাজের সুষ্ঠ ধারাবাহিতার স্বার্থে ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) প্রকৌশলী আবুল কাশেম ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন সভায় প্রতিনিধিত্ব করবেন পাশাপাশি প্রতিনিধি নির্বাচন ও রুটিন কার্যদি সম্পাদন করবেন। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার ওয়াসার বোর্ড সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে অংশ নেন তাকসিম এ খান। আর সেই বোর্ড সভা থেকেই করোনা মহামারির মধ্যে আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা ওয়াসা। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসাবে নিয়োগ পান প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। এরপর ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে তিনি নিজ পদে রয়ে গেছেন প্রায় ১২ বছর ধরে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছেন। অনেকে চাকরিহারা হয়েছেন। নগরে দারিদ্র্য বেড়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এখনই দাম বাড়ানো ঠিক হবে না বলে তিন থেকে চারজন সদস্য সভায় মত দিয়েছিলেন। কিন্তু আইন অনুযায়ী প্রতিবছর পানির দাম বাড়ানো যায় এবং দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, এসব যুক্তিতে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সঙ্গে মোবাইলে বারবার যোগাযোগ করা হলে ব্যস্ত আছেন উল্লেখ করে ফোন কেটে দেন। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।

দেশে বিদ্যমান করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে পানির মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য, অমানবিক ও সুবিবেচনাপ্রসূত নয় বলে জানিয়েছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় সংগঠনটি। ক্যাবের তথ্য কর্মকর্তা আনোয়ার পারভেজের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমনিতেই যখন দীর্ঘ সময় ধরে দেশে বিদ্যমান করোনার কারণে জনগণ আর্থিক সংকটের সম্মুখীন, তখন আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে পানির মূল্য বৃদ্ধির জন্য ওয়াসার প্রস্তাব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মহামারির এই দুর্যোগে দীর্ঘসময় ধরে লকডাউন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়াসার পানির মূল্য বৃদ্ধি করা হলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, ফলে মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে বলে মনে করে ক্যাব। ক্যাব বলছে, সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে এমনিতেই মানুষ দিশেহারা। এমতাবস্থায় ওয়াসার পানির মূল্য বৃদ্ধি করা সাধারণ মানুষের জন্য হবে মরার ওপর খারার ঘা। প্রতিবছর ওয়াসার পানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, পানি সরবরাহ সংকটাপন্ন। অথচ ওয়াসার পানির মান নিয়ে রয়েছে মানুষের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ক্যাব মনে করে, ঢাকা ওয়াসা পানি উৎপাদনের জন্য ব্যয়ের কথা বলে পানির যে দাম বৃদ্ধি করেছে, তা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।

https://dailysangram.com/post/453474