২৬ মে ২০২১, বুধবার, ২:২৩

১০ মাসে সরকারের ব্যাংক ঋণ ৩০১৮২ কোটি টাকা

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। তবে আলোচ্য সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২৮ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা ঋণ ফেরত দেয়া হয়েছে। ফলে আলোচ্য সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার প্রকৃত ঋণ নিয়েছে এক হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের শেষ মাসে ঠিকাদারের বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটায় ব্যয় বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে ব্যাংক ঋণের ওপর। এর পরেও বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ লক্ষ্যমাত্রার নিচেই থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংকাররা জানান, গেল বছর থেকে করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি থেমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে নতুন করে ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। ঋণ বিতরণ কমিয়ে দেয়ায় প্রতিটি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ঋণ দিতে প্রতিযোগিতা করছে। ৫০০ কোটি টাকার ট্রেজারি বিল বন্ড নিলামের বিপরীতে ৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিলামে অংশগ্রহণ করছে।

এ দিকে সরকার বাজেট ঘাটতি অর্থায়ন মেটাতে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে মূলত দু’টি উপায়ে ঋণ নিয়ে থাকে। একটি ব্যাংকিং খাত। অপরটি ব্যাংকবহির্ভূত খাত। ব্যাংকিং খাতের মধ্যে আবার তফসিলি ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়। তফসিলি ব্যাংকগুলো অনেক সময়ে তহবিল সঙ্কটে সরকারের প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান দিতে পারে না। তখন সরকার জরুরি প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। আর মুদ্রা সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এ কারণে সরকার নিরুপায় হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে। আবার ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে টান পড়ে। কারণ সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি ঋণ নিলে ব্যাংকগুলো বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান দিতে পারে না। এর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যায়।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্যসব ঋণের সুদ ৯ শতাংশের বেশি নিতে পারে না। এক দিকে করোনার প্রভাব, অপর দিকে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ার প্রবণতায় ব্যাংকগুলো চলমান অবস্থায় বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। কারণ ১০০ টাকা ঋণ দিয়ে ৯ টাকার বেশি মুনাফা পাওয়া যায় না। আবার ওই ঋণ গ্রাহক ফেরত না দিলে পুরোটাই ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। কিন্তু সরকার দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিলে মুনাফা ৮ শতাংশের ওপরে পাওয়া যায়। অন্য দিকে সরকারকে ঋণ দেয়া হলে তা শতভাগ নিরাপদ থাকে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো তাদের প্রয়োজনে ট্রেজারি বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বন্ধক রেখে নগদ অর্থের সংস্থান করতে পারে। সবমিলে কিছু কিছু ব্যাংক এখন সরকারকে ঋণ দিতেই নিরাপদ বোধ করছে। এরই প্রভাব পড়ছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে।

সরকারের ঋণ গ্রহণের সবশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ৩০ জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। গত ৫ মে তা নেমেছে ১৫ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায়। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা।

তবে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করলেও তফসিলি ব্যাংক থেকে ঠিকই ঋণ নিয়েছে। যেমনÑ গত বছরের ৩০ জুনে তফসিলি ব্যাংকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। গত ৫ মে তা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। গত ১০ মাসে সরকার তফসিলি ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৩০ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা।

তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফেরত দেয়ায় আলোচ্য সময়ে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রকৃত ঋণ নেমেছে এক হাজার ৬৩৬ কোটি টাকায়। গত বছরের জুনে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণ ছিল এক লাখ ৭৭৬ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। গত মে মাসে তা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এরই প্রভাবে ৫ মে পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক ঋণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঠিকাদারের অর্থ ছাড় ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ায় অর্থবছরের শেষ মাসে বড় অঙ্কের ব্যয় হয়। এ কারণে অর্থবছরের শেষ মাসে বড় অঙ্কের ঋণ করতে বাধ্য হয় সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এক দফা সংশোধন হয়ে তা প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এরপরেও এবার ব্যাংকবহির্ভূত খাত সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণ নেয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ ৫০ হাজার কোটি টাকার নিচেই থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/584172