সাবেক এমপি এমএ আউয়াল। ফাইল ছবি
২২ মে ২০২১, শনিবার, ১:৪১

চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দিন হত্যা

আউয়ালের যত অপকর্ম

রাজধানীর পল্লবীতে চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক এমপি এমএ আউয়াল এখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। ১৬ মে সাত বছরের শিশুসন্তানের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাহিনুদ্দিনকে। সুমন বাহিনীর প্রধান সুমনের নেতৃত্বে কিলিং মিশন বাস্তবায়িত হলেও আলোচিত এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসাবে উঠে আসে আউয়ালের নাম। ২০ মে ভোরে আউয়ালকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তিনি এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে রিমান্ডে রয়েছেন। সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর একে একে বেরিয়ে আসছে আউয়ালের নানা অপকর্ম।

নিহত সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগম জানান, পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বুড়িরটেকে (আলীনগর) তার ও তাদের স্বজনদের ১০ একর জমি রয়েছে। আশপাশের কিছু জমি দখল করে সেখানে হ্যাভেলি প্রপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড নামে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলেন আউয়াল। তাদের জমি জবরদখলে ব্যর্থ হয়ে গত বছরের নভেম্বরেও সাহিনকে কুপিয়ে আহত করেছিল তার ক্যাডাররা। সেই ঘটনায় করা মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। উলটো আউয়ালের দেওয়া এক মামলায় সাহিনুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে সাহিনুদ্দিন জামিনে মুক্তি পান।

স্থানীয়রা জানায়, জমির দালাল থেকে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক বনে যাওয়া এমএ আউয়ালের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন মিরপুর-পল্লবীর বাসিন্দারা। জমি দখলের জন্য ৩০ সদস্যের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কাউকে বাসা থেকে ধরে আনতে বা রাস্তায় কুপিয়ে-পিটিয়ে রক্তাক্ত করতে এ বাহিনীকে ব্যবহার করা হতো। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, আউয়াল ২০০২ সালে পল্লবীর আলীনগরে আসেন সাহিনুদ্দিনের বড় ভাই মাইনুদ্দিনের হাত ধরে। মাইনুদ্দিন-সাহিনুদ্দিনদের জমি ১৩/১৯৫৯/৬০ এবং ৫/৭২/৭৩ এলএ কেসের মাধ্যমে জাতীয় গৃহায়ন অধিদপ্তর জাতীয় রক্ষীবাহিনীর স্থাপনা নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করেছিল। রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত হওয়ার পর জাতীয় গৃহায়ন অধিদপ্তর এ জমি দীর্ঘদিন পতিত অবস্থায় ফেলে রাখে। জমির হালনাগাদ তথ্য করার সময় ভুলবশত বিএস রেকর্ড আগের মালিকদের নামে হয়ে যায়। জায়গাটির অধিগ্রহণ অবমুক্ত করে দেওয়ার বিনিময়ে জমির একটি অংশ আউয়ালকে দেওয়ার শর্তে মাইনুদ্দিন-সাহিনুদ্দিনদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু তিনি জমি অধিগ্রহণ অবমুক্ত করতে পারেননি। পরে আউয়াল সেখানে আবাসন প্রকল্প করে প্লট বাণিজ্য শুরু করেন এবং সাহিনুদ্দিনদের জমি দখলের পাঁয়তারা করেন।

৭ মে পল্লবী থানায় দায়ের হওয়া এক মামলার বিবরণে বলা হয়, বুড়িরটেকে আলীনগর আবাসিক এলাকার বাউনিয়া মৌজার সিএস ও এসএ ৩১২৪ দাগের ৮৪ শতাংশ জায়গায় নজর পড়ে সাবেক এমপি আউয়ালের। আউয়াল তার বাহিনী দিয়ে বিভিন্নভাবে ওই জমি দখলের চেষ্টা চালায়। জায়গাটি দখল করতে আউয়ালের বাহিনী একাধিকবার সেখানে হামলা চালায়। জমির মালিকের স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপরও ওই জমি দখল করতে না পেরে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জমির মালিকের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। এক পর্যায়ে আউয়ালকে চাঁদা দিতে বাধ্য হন জমির মালিক। চাঁদার টাকা দেওয়ার দৃশ্য সিসি ক্যামেরায় সংরক্ষিত রয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসাবে তরিকত ফেডারেশন থেকে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে এমপি নির্বাচিত হন এমএ আউয়াল। এরপর তিনি হয়ে পড়েন লাগামছাড়া। বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ২০১৮ সালের ১৬ এপ্রিল তাকে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিবের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে তিনি ইসলামি গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান হন। ২০১৮-এর নির্বাচনেও এমপি পদে মনোনয়ন দাখিল করেন। কিন্তু ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে তখন তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। ওই সময় তার ১২ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ ছিল।

সূত্র জানায়, এমপি থাকাকালে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাটসহ নানা অভিযোগে বিতর্কিত হয়ে উঠেন এমএ আউয়াল। হতদরিদ্রদের মাঝে ঘর নির্মাণ এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং থাকার যোগ্য হবেন না। কিন্তু সংসদ সদস্য থাকাকালে আউয়াল স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সৌর বিদ্যুতের আওতায় আনার প্রস্তাব দেন। পরে তার কোম্পানি হ্যাভেলি এনার্জি ও টেকনোলজি প্রাইভেট লিমিটেড এ কাজ হাতিয়ে নেয়। একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি রাজধানীর পল্লবীতে ৬৬ শতক জমি, যার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা ও নিজ গ্রামে ৬০ লাখ টাকা মূল্যের এক তলাবিশিষ্ট ভবন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া হ্যাভেলি প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ও মেসার্স ইয়ুথ এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর উল্লেখ করলেও হ্যাভেলি এনার্জি ও টেকনোলজি প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালনার কথা গোপন রাখেন।

নিহত সাহিনুদ্দিনের স্ত্রীর বড় ভাই জহিরুল ইসলাম বলেন, কেবল সাহিনুদ্দিন হত্যাকাণ্ডই নয়, আলীনগরের জমি দখলকে কেন্দ্র করে এর আগেও বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার। ২০১৫ সালের ১৪ মে সকালে উত্তর কালশীর আলীনগর এলাকায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন মিরপুরের বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের ছাত্র আব্দুর রহমান চঞ্চল। ওই সন্ত্রাসী হামলায় সাহিনুদ্দিন (সম্প্রতি নিহত) ছাড়াও আহত হন রাজীব ও মোহাম্মদ আলী (৩২) নামে দুই গ্রুপের তিনজন। রাজীবের বাম হাতের কবজির নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়েন সাবেক এমপি আউয়াল। আউয়ালের নির্দেশে কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন নিহত সাহিনুদ্দিনের চাচাতো ভাই বাবুর শ্যালক মোমিন বক্স। মোমিন তখন আউয়ালের মালিকানাধীন হ্যাভেলি প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের প্রজেক্ট ইনচার্জ ছিলেন। চঞ্চল হত্যাকাণ্ডের দুই মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ১২ জুলাই সকালে কালশীর বাউনিয়া বাঁধ সড়কের একটি সেতুর কাছ থেকে মোমিন বক্সের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ‘ডিবি’ পরিচয়ে অপহরণের চারদিন পর তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই দুই খুনের কয়েক বছর আগে পল্লবীর উত্তর কালশী এলাকায় তিন রাস্তার মোড়ে একটি ড্রেনের পাশে মেলে সাহিনুদ্দিনের চাচাতো বোনের ছেলে আব্বাসের লাশ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/423795/