২২ মে ২০২১, শনিবার, ১:৪০

ঘরে ঘরে কান্না মাদারীপুরের

চোরাইপথে ইতালি প্রবেশ করতে গিয়ে ট্রলারডুবি; ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় অনেকে; বেপরোয়া দালালচক্র

মাদারীপুরের ঘরে ঘরে এখন কান্নার রোল। একটু সুখের আশায় বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে এখন অনেকেরই হদিস নেই। ধারণা করা হচ্ছে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় হয়তো তারা মারা গেছেন। না হলে কোনো দেশের জেলে আছেন। স্বজনদের খোঁজ না পেয়ে ওই সব পরিবারে এখন দিন-রাত সমান হয়ে গেছে। স্বজনকে ফিরে পেতে দিনরাত কাঁদছেন পরিবারের সদস্যরা। পরিবারগুলো থেকে জানানো হয়েছে, ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে দালালরা ওই যুবকদের নিয়ে গেছে।

শুধু মাদারীপুর থেকেই গত ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে কয়েক হাজার যুবক ইতালি পাড়ির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছে। এর মধ্যে তিন শতাধিকের কোনো খোঁজ নেই বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সেন্টু নামে একজনের লাশ উদ্ধার করেছে তিউনিসিয়ার নৌপুলিশ। লিবিয়া থেকে কাঠের ট্রলারে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তিউনিসিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। মানবপাচারকারীরা ওই সব যুবক ও তার পরিবারকে বেশি টাকা আয়ের লোভ দেখিয়ে এই সর্বনাশ ডেকে এনেছে।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, মাদারীপুর সদর থানা এলাকার পেয়ারপুর ইউনিয়নের শ’খানেক যুবক ইতালি পাড়ি জমাতে গিয়ে ৩৯ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার মধ্যে নয়ারচর গ্রামেরই রয়েছে ২১ জন। এরা হলেন, জামাই সেন্টু, তার স্ত্রীর নাম সাথী, ইমরান মাতুব্বর, বাবা খলিল মাতুব্বর, জীবন ফরাজী, বাবা আবদীন ফরাজী, সাইফুল ফরাজী, বাবা আয়ুব ফরাজী, বিলাল ফরাজী, বাবা মাসুম ফরাজী, জিহাদ মাতুব্বর, বাবা হারেছ মাতুব্বর, আশিক মাতুব্বর, বাবা খলিল মাতুব্বর, মহিউদ্দিন ফরাজী, বাবা বাবুল ফরাজী, সাগর জমাদার, বাবা আজিজ জমাদ্দার, শওকত মীর, বাবা জাফর মীর, অনিক তালুকদার, বাবা বিলাল তালুকদার, রাশেদ জমাদ্দার, বাবা শহিদুল জমাদ্দার, রাব্বি বেপারী, বাবা ইমদাদ বেপারী, রানা মাতুব্বর, বাবা রশিদ মাতুব্বর, রাসেল শেখ, বাবা আজিবুর শেখ, শাহিন হাওলাদার, বাবা ইসমাইল হাওলাদার, হাফিজ হাওলাদার, বাবা আবু সাঈদ হাওলাদার, শাহজালাল শেখ, বাবা শওকত হাওলাদার, রাজিব বেপারী, বাবা নান্নু বেপারী, সুমন মৃধা, বাবা আবদুল মান্নান মৃধা, হেলাল মৃধা, বাবা লুৎফর মৃধা এবং ইসমাইল মৃধা বাবা লুৎফর রহমান। এরা সবাই একই গ্রামের মিজান মাতুব্বর, মহসিন মাতুব্বর, ফজলু মাতুব্বর এবং মোক্তার মাতুব্বরকে বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা দিয়েছে বলে জানা যায়। পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে ইতালি যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা এভাবে চোরাইপথে ইতালি পাঠাবে তা পরিবারগুলো জানতো না। ঈদের আগে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে নেয়া হয়। যারা জীবিত রয়েছেন, তারা বাড়িতে খবর দিয়েছেন, তাদেরকে নিয়ে চারটি ট্রলারে করে সাগর পাড়ি দেয়া হচ্ছিল। পথে এই ট্রলারগুলো ডুবে যায়। তার মধ্যে একজনের লাশ উদ্ধার করেছে তিউনিসিয়ার পুলিশ। নিহতের নাম জামাই সেন্টু। তার স্ত্রী সাথী জানান, স্থানীয় দালাল মিজান ফুসলিয়ে আট লাখ টাকা নিয়ে বাংলাদেশের এয়ারপোর্ট দিয়ে দুবাই যায়। পরে ওখান থেকে আবার লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তিউনিসিয়া গেলে ১৮ মে মঙ্গলবার ট্রলার ডুবে তার স্বামী মারা যায়। ওই ট্রলারে যারা ছিল তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে জানায় দালাল মিজান। সাথী আরো জানান, তিন মেয়ে নিয়ে তাদের পরিবার। এখন কে দেখবে তাদের বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। অন্যদিকে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়াকালে তিউনিসিয়া এরিয়ায় সাগর থেকে দুইজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তারা হলো মনির বেপারী, বাবা সোবহান বেপারী এবং সৈকত মোল্লা, বাবা সিকান্দার মোল্লা। মনির বেপারী ২০ মে তিউনিসিয়ার একটি হাসপাতাল থেকে দেশে ফোন দেন। তার বাবা সোবহান বেপারী সাংবাদিকদের জানান, তার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে আমিনুল দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী। ছোট ছেলে মনির এইচএসসি পাস করার পরে আর লেখাপড়া না করায় বেকার হয়ে ঘুরছে। তাই স্থানীয় দালাল মিজানের কথামতো সাড়ে সাত লাখ টাকা দেন মিজানকে। তিনি বলেন, তার ছেলে হাসপাতালে ভর্তি আছে। ফোনে কথা বলছে।

সূত্র জানায়, মাদারীপুর জেলার প্রায় প্রতিটি ঘরে প্রবাসী রয়েছেন। এদের বেশির ভাগই ইতালি এবং গ্রিসে থাকেন। আর অধিকাংশ গেছেন বৈধ ভিসায়। সারা বিশ্বে যখন কোভিড-১৯ আতঙ্কে। তখন স্থানীয় দালাল চক্রটি পরিবারকে অধিক আয়ের লোভ দেখিয়ে ভুল বুঝিয়ে বেকার যুবকদের ইতালি প্রবাসী বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। গত ৫ মাসে মাদারীপুর জেলা থেকে অসংখ্য যুবক বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। লিবিয়া সাগরপাড়ে হাজার হাজার লোক এখনো ইতালি পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় বলে জানা গেছে। মাদারীপুরে সদর থানা এলাকায় চিহ্নিত যেসব দালাল তাারা হলোÑ মিজান মাতুব্বর, মহসিন মাতুব্বর, বজলু মাতব্বর, মোক্তার মাতুব্বর, জসিম মোল্লা, আকবর মোল্লা এবং আম্বিয়া। এদের সহযোগী ঢাকায় অবস্থান করছে, আনোয়ার ওরফে কাশেম, লিয়াকত, কাদের এবং সোবহান দুবাই অবস্থান করছে। লিবিয়ায় অবস্থান করছে, নজরুল, সেলিম, জিয়া ও খলিল।

এ দিকে, পেয়ারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান খান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ট্রলার ডুবেছে তিনি শুনেছেন। তবে কেউ মারা যাওয়ার খবর তার কাছে নেই। আর এদের মধ্যে তার ইউনিয়নের কেউ নেই।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/583735