১৪ এপ্রিল ২০২১, বুধবার, ৩:০৯

পোলট্রি খাদ্যের দাম বেশি : উৎপাদিত পণ্যের দাম কম

উভয় সংকটে কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারি

উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে : সচিব * দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি

‘খামারিদের গলা চাইপা মাইরা ফালান। ধীরে ধীরে মরার থেকে একবারে মরাই ভালো। আর সহ্য হয় না। খাবারের দাম বাড়ে আর ডিমের দাম কমে। হায়রে আজব দেশ! এই দেশ থেকে মন চায় অন্য কোথাও চলে যাই।’ পোলট্রির খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে নিজের ফেসবুক পেজে এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন খামারি সোহেল রানা।

আরেক খামারি জাহাঙ্গীর তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন: ‘প্রতি কেজি খাদ্যের দাম ১ টাকা বেড়েছে। আর মুরগির বাচ্চার মূল্য ৬০ টাকা। এ অবস্থায় বাচ্চা তুলে নদীতে সাঁতার দিতে হবে।’

খামারি আলী আজাদ ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন: ‘চিন্তা করার টাইম নাই। খাদ্যের ব্যাগের মূল্য ২৪শ-২৫শ টাকা, বাচ্চার মূল্য ৬০-৬২ টাকা। অপরদিকে এক কেজি মুরগির মূল্য ১১০ টাকা, ডিমের হালি ৫-৮ টাকা। এরপরও বাচ্চা তোলাই লাগবে...লোকসান গুনতে হবে।’

কঠোর লকডাউন ঘোষণা ও পোলট্রি ফিডের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আর সোহেল রানা, জাহাঙ্গীর ও আলী আজাদের স্ট্যাটাসে উঠে এসেছে সে বিষয়টি।

জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, লকডাউনে প্রান্তিক খামারিরা যাতে ক্ষতির মুখে না-পড়েন, সেজন্য ভিন্ন চিন্তা করা হচ্ছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে পণ্য বাজারজাতের ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য পরিবহণ ও বিক্রির ব্যবস্থায় সব ধরনের সহায়তা করা হবে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে পারলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তিনি বলেন, পোলট্রি খাদ্যের বাজারের ওপর সরকারের নজরদারি রয়েছে। সিন্ডিকেট করে মূল্য বাড়ানো হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নিয়ে পোলট্রি খাতের সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, ‘পোলট্রি ফিড তৈরির উপকরণ ভুটা ও সয়াবিনসহ সবকিছুর দাম ৩০-৩৫ শতাংশ বাড়ছে। কিন্তু সেভাবে বাড়েনি মুরগির মাংস ও ডিমের মূল্য। বেশি দাম দিয়ে খাবার কিনে ফার্মে মুরগি পালন করা কষ্টকর। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বেড়েছে। ফলে লোকসান গুনতে গিয়ে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।’

জানা যায়, সম্প্রতি ৫০ কেজি ব্রয়লার মুরগির খাদ্যের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। লেয়ারের দাম ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ৭৫ টাকা। প্রতি টন খাদ্যের দাম বর্তমানে ৪১ হাজার টাকা, যা গত বছর ছিল ৩১ হাজার টাকা।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশীমুল গ্রামের বিসমিল্লাহ পোলট্রি খামারের মালিক বিলাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, করোনায় ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। মহামারির প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর নতুন লকডাউনে আরও ক্ষতির মুখে পড়েছি। করোনার দ্বিতীয় ধাপে ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ টাকা। এ ছাড়া হঠাৎ করে খাদ্যের দাম বেড়েছে। প্রতি টনে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত বছর এক টন পোলট্রি ফিডের দাম ছিল ৩১ হাজার টাকা, তখন ডিমের দাম ওঠে ৭-৮ টাকা, আর বয়লারের দাম ১১০-১২৫ টাকা। এই বছর পোলট্রি খাদ্যের টন ৪১ হাজার টাকায় ওঠে। অপরদিকে ডিমের দাম কমে ৫-৬ টাকায় নেমেছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি কোনো প্রণোদনা সহায়তা পাইনি। আমার সঙ্গে আরও ২০ জন খামারি আছেন, তারাও পাননি।

এই উপজেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানা বেজুরা গ্রামের খামারি শহিদুল ইসলাম বলেন, খাদ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু লকডাউনে মুরগির দাম কমছে। লোকসানের কারণে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি। খামারি ফিরোজ বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় ব্যবসা চালাতে কষ্ট হচ্ছে। ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থা।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবে ২০২০ সালের লকডাউনে দেশে ৩০-৩৫ শতাংশ পোলট্রি ফার্ম বন্ধ হয়ে যায়। করোনায় সব মিলিয়ে এ খাতে ক্ষতি হয় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্রিডার্স ইন্ডাস্ট্রি খাতে ৪৫৮ কোটি টাকা, ফিড শিল্পে ৭৫ কোটি টাকা, বাণিজ্যিক পোলট্রি (ডিম ও মাংস) খাতে ৫০৩ কোটি টাকা, প্রসেসড ইন্ডাস্ট্রিতে ৩১ কোটি টাকা ও ওষুধ মিনারেল প্রিমিক্সসহ অন্যান্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৮৩ কোটি টাকা।

এদিকে পোলট্রি খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ (বিপিকেআরজেপি) সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। সেখানে পরিষদের সভাপতি খন্দকার মুহাম্মদ মুহসিন বলেন, করোনায় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমনিতেই উৎপাদনমূল্য পাচ্ছেন না তারা। এর মধ্যে পোলট্রি ফিডের দাম বস্তাপ্রতি ৫০-৭৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যদিও ভুট্টার মৌসুমে ফিডের দাম বাড়া অযৌক্তিক। স্মারকলিপিতে ফিডের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে আনার দাবি জানানো হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/city/411631