দেশে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় দৈনিক প্রায় ৬৫ মেট্রিক টন অক্সিজেন ঘটতি রয়েছে। কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে এবং বিভিন্ন শিল্পকারখানায় দৈনিক অক্সিজেন চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১৮০ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ উৎপাদন ও সরবরাহ করছে ৯০ মেট্রিক টন এবং স্পেক্ট্রা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের দৈনিক গড়ে সরবরাহ করছে ২৪ দশমিক ৫ মেট্রিক টন।
প্রতিদিন যেভাবে করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে এতে সার্বিক চিকিৎসা পরিস্থিতি অবনতি ঘটার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সুবিধা দিতে না পারলে অনেক মুমূর্ষু রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। এমন তথ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেশের অক্সিজেনের চাহিদা এবং সরবরাহ বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ এবং স্পেক্ট্রার প্রতিনিধিরাও সভায় উপস্থিত হয়ে তাদের সক্ষমতা তুলে ধরেন।
সভায় লিন্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে দুটি অক্সিজেন উৎপাদন প্লান্ট রয়েছে। এই দুটি প্লান্টে প্রতিদিন যথাক্রমে ৭০ মেট্রিক টন এবং ২০ মেট্রিক টন করে মোট ৯০ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদন করা হয়। এছাড়া স্পেক্ট্রা আমদানি ও উৎপাদনের মাধ্যমে ২৪ দশমিক ৫ মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা ১০ থেকে ১৫ মেট্রিক টন। বাকি অক্সিজেনের বেশিরভাগ চাহিদা কোভিড চিকিৎসায় যুক্ত হাসপাতালগুলোতে। পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালেও সরবরাহ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, দেশে কোভিড চিকিৎসা দেয় (সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে) এমন হাসপাতালগুলোতে ১০৩৭টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে। শুধু এই হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাগুলো মাধ্যমে প্রতিদিন মুমূর্ষু রোগীদের জন্য ৬৪ মিলিয়ন লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এছাড়া আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্টে রাখতে হয়।
পাশাপাশি সাধারণ শয্যায় চিকিৎসাধীন অনেক রোগীরও অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। এর পাশাপাশি সারা দেশে সাধারণ হাসপাতালে (যেগুলোতে নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়) প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগীর অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। তাদেরও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এমনকি দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অবস্থাসম্পন্ন অনেক ব্যক্তি ও পরিবার বাসা-বাড়িতে অক্সিজেন সিলেন্ডার রাখতে শুরু করেছে।
সভায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরহকারী প্রতিষ্ঠান দুটির প্রতিনিধিদের কাছে এই সংকটের সমাধান জানতে চায়। এ সময় লিন্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা একটি নতুন অক্সিজেন প্লান্ট করার প্রস্তাব দিয়েছে, যা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্লান্টটি করতে কমপক্ষে ৯ মাস সময় লাগবে। তবে নারায়ণগঞ্জে তাদের একটি ট্যাংক রয়েছে যেটিতে ৯ মেট্রিকটন অক্সিজেন মজুদ রাখা সম্ভব। বর্তমান ঘটিতে মেটাতে তারা লিন্ডে ইন্ডিয়ার কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০ থেকে ৮০ টন অক্সিজেন আনছে। যে ট্যাংকারের মাধ্যমে অক্সিজেন আনা তার প্রত্যেকটি ধারণ ক্ষমতা সাড়ে ৪ টন থেকে ১৪ টন।
তবে এভাবে কতদিন অক্সিজেন আনা সম্ভব হবে সে বিষয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলেন, ইতোমধ্যে ভারতের মহারাষ্ট্র সরকার রাজ্যের বাইরে অক্সিজেন সরবরাহ ও পরিবহণ বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে অক্সিজেন আনা হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যদি অক্সিজেন পরিবহণ ও সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করে তাহলে পরিস্থিতি ভায়বহ আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি হাসপাতালগুলোতে চাহিদা অনুসারে অক্সিজেন সরবরাহ করতে না পারলে করোনা আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
এ বিষয়ে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অধিকাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী মৃদু বা মাঝারি লক্ষণ প্রকাশ করে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হয়। পর্যাপ্ত হাইফ্লো অক্সিজেন সাপ্লাই থাকলে তাদের ভেতর থেকেও একেবারে হাতে গোনা দুয়েকজনের আইসিইউ সুবিধার প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে রোগীরা আইসিইউতে আসার আগ পর্যন্ত যে চিকিৎসা, সেটি পাচ্ছে না। ফলে আইসিইউয়ের চাহিদা বাড়ছে। সুতরাং এই মুহূর্তে আইসিইউ শয্যা বৃদ্ধি করার চেয়েও জরুরি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা। তবে এক বছর সময় পাওয়ার পরও সরকারি হাসপাতালগুলোতে হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এই বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সারা দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫ হাজার ৮৪ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ২২৩ জন। একই সঙ্গে আইসিইউতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৯৪ জন। এছাড়া আরও অনেকের আইসিইউর প্রয়োজন থাকলে শয্যার অভাবে তাদের আইসিইউতে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন যুগান্তরকে বলেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের বেশিরভাগেরই অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। মূলত এখন যাদের অক্সিজেনর প্রয়োজন হয় না তাদের হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাসায় চিকিৎসা নিতে বলা হয়। ভর্তি রোগী ৫ শতাংশের ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে কোভিড চিকিৎসায় অক্সিজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) এবং কোভিড সংক্রান্ত মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অক্সিজেনের চাহিদা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। আশা করছি কোনো বড় ধরনের সংকট হবে না।