নিউমার্কেটে রোববার উপচেপড়া ভিড়, স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা নেই। ছবি: স্টার মেইল
১২ এপ্রিল ২০২১, সোমবার, ৩:৩৯

‘লকডাউন’র সপ্তম দিন

করোনা নিয়ন্ত্রণে মিলছে না কার্যকর ফল

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ বা ‘লকডাউন’র সপ্তম দিনে রোববারও স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে সর্বত্র মানুষ চলাচল করেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী ‘লকডাউন’ বাস্তবায়নে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর সুফল মিলছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে গত ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ‘লকডাউন’ গতকাল ১১ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, গতকাল সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে ১২ ও ১৩ এপ্রিল ‘লকডাউন’র মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ দু’দিনও একই নিয়মে চলবে দেশের সার্বিক কার্যক্রম। আর সরকার ঘোষিত ‘লকডাউন’ মধ্যেও গণপরিবহণ মালিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের মুখে সরকার ৭ এপ্রিল সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন ও ৯ এপ্রিল শপিংমল খুলে দেয়। আর গণপরিবহণ খুলে দেওয়ায় ৮ এপ্রিল উবার রাইড (মোটরবাইক ছাড়া) শেয়ারিং চালু করে। এরপর বলা চলে নামমাত্র ‘লকডাউন’ থাকলেও দেশের শহরগুলোয় পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক দিনের মতো। এ অবস্থার মধ্যে সড়কে যানজট ও মার্কেটে হাজারো মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল।

গত এক সপ্তাহে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বিশ্লেষণে ‘লকডাউন’র সময়েও দেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেড়েছে বলে প্রতিয়মান হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ৪ এপ্রিল দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল সাত হাজার ৮৭ জন। এদিন মৃত্যুবরণ করে ৫৩ জন। চলমান নিষেধাজ্ঞা শুরুর দিন ৫ এপ্রিল এ চিত্র ছিল আক্রান্ত ৭৫ হাজার ৭৫ জন, মৃত্যু ৫২ জন। সর্বশেষ রোববার আক্রান্ত পাঁচ হাজার ৮১৯ জন এবং মৃত্যুবরণ করেন ৭৮ জন।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, গত সাত দিনের ‘লকডাউন’ করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুতে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। গত এক সপ্তাহের করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর চিত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, আক্রান্ত কিছুটা কমলেও মৃত্যুর হার বেড়েছে। আর কয়েক দিন আক্রান্ত কম হওয়ার অন্যতম কারণ, করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে হাজার হাজার মানুষ পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না। এসব রোগীকে পরীক্ষা করানো গেলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়ত বলে তাদের অভিমত।

সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার রাজধানীসহ দেশের মহানগর ও সর্বত্র মানুষের স্বাভাবিক দিনের মতো চলাচল লক্ষ করা গেছে। সড়কে তীব্র যানজট, কাঁচাবাজার, মার্কেটে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করেনি কেউ। আর আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক ‘লকডাউন’র আভাস দেওয়ায় শ্রমজীবী, নিম্নআয়ের মানুষ, চিকিৎসাসেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে ফিরে যেতে দেখা গেছে।

আরও জানা যায়, রাজধানীর ধানমণ্ডি, সাইন্সল্যাব, মিরপুর রোড, কাওরান বাজার, পান্থপথ, পল্টন, বাংলামোটর, গুলশান, উত্তরা, কুড়িল, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মিরপুরসহ সর্বত্র সড়কে তীব্র যানজট এবং উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে। আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি চরমভাবে উপেক্ষা করতে দেখা গেছে। যানবাহন চলাচল, বাজার, শপিংমল এবং সড়কে মানুষের অবাধ চলাচল দেখে মনে হয়নি দেশে কোনো বিধিনিষেধ চলছে। ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে দীর্ঘক্ষণ যানজট লেগে থাকার দৃশ্যও দেখা গেছে। কেউবা কাজের উদ্দেশ্যে ছুটছেন কর্মস্থলে, অনেককে প্রয়োজন ছাড়াও বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।

পল্টন মোড়ে কথা হয় যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা ইমরান হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, “অফিস খোলা রেখে লকডাউন হয় নাকি, আজকে অফিসের কাজে তিন জায়গায় যেতে হয়েছে। অফিসের কথা শুনব, নাকি ‘লকডাউন’ মানব।”

মগবাজারে কথা হয় বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগামী ১৪ তারিখ থেকে সরকার কঠোর লকডাউন দেয়ার পরিকল্পনা করছে। সে কারণে জরুরি প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছি। এদিকে বিভিন্ন ব্যাংকের সামনে গ্রাহকদের বড় লাইনও দেখা গেছে। গতকাল গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাসটার্মিনাল এলাকা দিয়ে রাজধানী ছেড়ে শত শত মানুষকে ঢাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় মানুষ মোটরবাইক, প্রাইভেকটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক, পিকাপে চড়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ঢাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। এদের কেউ শ্রমজীবী, কেউ কর্মজীবী যাদের অফিস বন্ধ, কেউ চিকিৎসা নিতে ঢাকায় এসেছিলেন, ছুটি হওয়ায় চলে যাচ্ছেন। আর কেউ কেউ দীর্ঘ ছুটির আশঙ্কায় গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। কেননা, তারা মনে করছেন সরকার ১৪ তারিখ থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করলেও এটার সময়কাল ধাপে ধাপে বাড়তে পারে। সেজন্য তারা এ ছুটি গ্রামে প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটাতে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। গণপরিবহণ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঢাকার প্রবেশ ও বহিরাগম পথে কঠোর নজরদারি রেখেছেন। তবে যৌক্তিক ও মানবিক কারণ থাকায় প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাকে মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে না পুলিশ। রোববার গাবতলী ও সায়েদাবাদ এলাকা দিয়ে আশপাশের এলাকার অনেক মানুষকে হেঁটে ঢাকা থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে চলাচল করতে দেখা গেছে। অসুস্থ, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষদের ভোগান্তির মাত্রা ছিল অনেক বেশি।

গাবতলী বাসটার্মিনাল এলাকায় কথা হয় সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাবার সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেছে। ‘লকডাউন’র আগে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। ছুটি হওয়ায় এখন গ্রামে চলে যাচ্ছি। অ্যাম্বুলেন্স বেশি ভাড়া চাওয়ায় এখন বিকল্পভাবে যাওয়ার চেষ্টা করছি। জানি না, আল্লাহ কী করবেন?

সায়েদাবাদ বাসটার্মিনালের সামনের সড়কে কথা হয় কুমিল্লার ইমন হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করি। লকডাউনের কারণে অফিস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ঢাকায় না থেকে গ্রামে চলে যাচ্ছি। কারণ ধান উঠছে বাড়িতে কিছু কাজ করব। এ ছাড়া বউ ও ছেলে গ্রামে থাকে। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো যাবে। নিজের ব্যক্তিগত মোটরবাইক আছে। আস্তে ধীরে চলে যেতে পারব।

সরকারের চলমান ‘লকডাউন’ প্রসঙ্গে নগর বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, সরকার করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যে পদ্ধতিতে ‘লকডাউন’ বাস্তবায়ন করছে তাতে তেমন কোনো সুফল মিলছে না। এ অবস্থায় সুফল মিলারও কথা নয়। কারণ এটা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের আলোকে হচ্ছে না। সরকার নিজেদের মতো করে বিধিনিষেধ আরোপ করছে এবং সেটা তুলে নিচ্ছে। এটা কঠিন বাস্তবতাও রয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে ‘লকডাউন’ বাস্তবায়ন করা দুরূহ ব্যাপার। সবকিছু ঠিক রেখে স্বাস্থ্যবিধিগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সেটা সবার জন্য মঙ্গল হতো। কিন্তু খেঁটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর ও কর্মজীবীরা এসব মানতে চান না। এখানে তাদের জীবিকার প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সরকারকে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে মনে করি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/410993