১১ এপ্রিল ২০২১, রবিবার, ৩:৪৫

বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা লকডাউনের নামে তামাশা

এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এগিয়ে চলেছে না বলে বরং বলা যায়, ইতোমধ্যেই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে দেশ। এই লেখাটি নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই শুরু করেছি। বুধবার সরকার বলেছে, পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৬৩ ব্যক্তির। আর সংক্রমিত হয়েছে ৭ হাজার ৬২৬ জন। সংক্রমণের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত ৩ এপ্রিল শনিবার থেকে সংক্রমণ ৭ হাজারের ঘর ছুঁয়েছে। তারপর থেকে প্রতিদিন বাড়ছে। মাত্র ৪ দিনে বেড়েছে ৬ শতেরও বেশি। অথচ মার্চ মাসের প্রথম দিকেও এই সংখ্যা ৩ শতেরও নীচে ছিল। এক মাসের মধ্যে সংক্রমণের সংখ্যা ২৫ গুনেরও বেশি বেড়েছে। আমরা কেউ জানি না, সংক্রমণের এই উর্ধ্বরেখা কোথায় গিয়ে ঠেকবে।

বিগত এক বছরে মানুষ করোনা তথা মেডিকেল সায়েন্স সম্পর্কে অনেক পরিভাষার সাথে পরিচিত হয়েছেন। তারমধ্যে একটি হলো পিক (চবধশ) বা চূড়া। অর্থাৎ সংক্রমণ বাড়তে বাড়তে যেখানে গিয়ে ঠেকবে সেটি হলো চূড়া বা শিখর দেশ। চূড়া কিন্তু একটি সংখ্যা বা একদিনের ব্যাপার নয়। চূড়ায় ওঠার পর সংক্রমণ সেখানে অন্তত দুই তিন সপ্তাহ অবস্থান করে। সুতরাং আমরা এখনও জানিনা যে আজকের সংক্রমণের সংখ্যা ঐ ৭ হাজার ৬২৬ এ এসেই শেষ, না আরো বাড়বে। কেউ কিছু জানে না। তবে আশংকা হচ্ছে, এটা বাড়তেই থাকবে। এই আশংকা আমাদের মত সাধারণ মানুষের নয়, বলতে গেলে সমস্ত জনস্বাস্থ্যবিদ এবং সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যে আসবে সেটা আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অন্তত: ৬ মাস আগেই আগাম সতর্ক সংকেত দিয়েছিলেন। যারা সাবধান হবার তারা সাবধান হয়েছেন। তাঁরা পূর্বাহ্নিক প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু আমরা সাবধান হইনি। পূর্বাহ্নিক প্রস্তুতিও নেইনি। তার মারাত্মক পরিণতি আমরা ভোগ করতে শুরু করেছি।

একগাদা বিশেষজ্ঞের নাম করা যেতে পারে যারা বেশ কিছুদিন আগে সরকারকে শুধু লকডাউন নয়, প্রয়োজনে কারফিউ দেয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তু সবই অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়েছে। অবশেষে যখন লকডাউন জারি করা হলো তখন দেখা গেল, পর্বতের মুষিক প্রসব হয়েছে।

॥ দুই ॥
সরকার অবশেষে এক সপ্তাহের জন্য যে লকডাউন জারি করে, সেটাকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ‘অবৈজ্ঞানিক এবং দায় সারা (টহংপরবহঃরভরপ ধহফ যধষভ যবধৎঃবফ) বলে মন্তব্য করেছেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে এর দ্বারা কোনো ইতিবাচক ফল লাভ করা যবে না। তারা বলেন যে একদিকে বলা হচ্ছে লকডাউন দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে মানুষ এবং গাড়ি ঘোড়া অবাধে বিপুল সংখ্যায় চলাচল করছে। গণপরিবহণ বন্ধ ছিল। কিন্তু ২৪ ঘন্টাও সেগুলো বন্ধ রাখা যায়নি। ডেইলি স্টারের ভাষায় বাস মালিক এবং শ্রমিকদের ‘চাপের কাছে সরকার নতি স্বীকার’ করেছে। সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যদিও বলেছেন যে জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে বাস মালিক এবং শ্রমিকদের সংগঠন সরকারপন্থী। তাদের চাপের কাছেই সরকার নতি স্বীকার করেছেন। যদিও বলা হয়েছে যে দেশের শুধুমাত্র শহরাঞ্চলের মধ্যেই বাস চলাচল করবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে মফস্বলের বাস গাবতলী হয়ে ঢাকা মহানগরীর মধ্যেও পৌঁছানো শুরু করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা, বিশেষ করে সাভারের একাধিক ব্যক্তি বলেছেন যে একাধিক উত্তরবঙ্গগামী বাসকে তাঁরা সাভার বাজার পার হতে দেখেছেন। সুতরাং আন্তঃজেলা বাসও চলাচল শুরু করেছে আর পুলিশ সেগুলি দেখেও দেখছেনা।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রিদওয়ানুর রহমান বলেন, আমরা অত্যন্ত বাজে সময়, অত্যন্ত খারাপ সময়ে পতিত হতে যাচ্ছি। সরকার এক নিঃশ্বাসে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, আর অন্য নিঃশ্বাসে সেই সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে। এ যেন এক চোর পুলিশ খেলা। আমি আগেই বলেছি যে লেখাটি শুরু করেছি বৃহস্পতিবার। লেখাটি যখন এই পর্যায়ে এসেছে তখন দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণে দেখলাম, সমস্ত দোকানপাট আগামী ৯ এপ্রিল শুক্রবার থেকে ১৩ এপ্রিল মঙ্গলবার পর্যন্ত সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা-এই ৮ ঘন্টা খোলা থাকবে। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। ১৩ এপ্রিল সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যে ১৩ এপ্রিলের পরেও দোকান পাট খোলা থাকবে কিনা।

॥ তিন ॥
তাহলে ব্যাপরটা কি দাঁড়ালো? প্রথমে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলো। সেই ঘোষণাতেই অফিস আদালত, কল কারখানা, বইমেলা ইত্যাদি খোলা রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। গণপরিবহণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। গণপরিবহণের মালিক এবং শ্রমিকরা দাবি জানালো, গণপরিবহণ চলাচল করতে দিতে হবে। তাদের চাপে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সরকার গণপরিবহণ চলাচলেও ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হন। এটা দেখে বড় বড় শপিং মলসহ সব ধরনের দোকানের মালিক এবং কর্মচারীরা রাস্তায় নামলো। বললো, অফিস আদালত, কল কারখানা, বইমেলা, গণপরিবহণ খোলা রাখলে তারা কেন দোকান-পাট বন্ধ রাখবে? দোকান-পাট খুলে দিতে হবে। ব্যাস্, দোকান-পাটও খোলার পারমিশন দেয়া হলো। তাহলে আর বাকী থাকলো কি? তাহলে কোথায় গিয়ে ঠেকলো লকডাউন? একটি বাংলা সহযোগী দৈনিক ৭ এপ্রিল অনেক বড় বড় টাইপে প্রথম পৃষ্ঠায় লাল কালিতে বিশাল শিরোনাম দিয়েছে, “তামাশার লকডাউন”। শিরোনামটি সঠিক হয়েছে। সরকার করোনা মোকাবেলার নামে যা কিছু করছে, সেগুলিকে তামাশা ছাড়া আর কি বলা যায়? সরকার শুধু এক জায়গাতেই কঠোর। সেটা হলো বিরোধী দলসমূহের বেলা। বিরোধীরা মিছিল করতে গেলে সেখানে নিষেধাজ্ঞা, সভা করতে গেলে নিষেধাজ্ঞা, এমনকি মানববন্ধন করতে গেলেও নিষেধাজ্ঞা। বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচারপার্ক, অন্যান্য সুপারশপ, নিউ মার্কেট, বইমেলা- ইত্যাদিতে যত লোক হয়, তার ভগ্নাংশও কি রাজনৈতিক সমাবেশগুলিতে হয়? তাহলে সবই যখন খুলে দেয়া হলো তখন আর রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ থাকবে কেন?

বলা হচ্ছে এবারের ভাইরাসটি গত বছরের ভাইরাসের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। এটি নাকি বৃটিশ ভ্যারিয়েন্ট। আবার বৃহস্পতিবার বলা হলো, এসব ভাইরাসের ৮১ শতাংশ সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর এবং সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বিলাতের যেসব যাত্রী অবতরণ করেন তাদের মধ্যে যাদের করোনা হয়েছে সেই করোনা ভাইরাসের জেনোম সিকুয়েন্সিং করা হয়। করে ইংলিশ বা সাউথ আফ্রিকান স্ট্রেইন (ভ্যারিয়েন্ট) শনাক্ত করা হয়। সেটা তো হলো জানুয়ারি মাসের কথা। অথচ তার পরেও ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা বা বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কঠোর প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করা হয়নি। আমরা কয়েকজন বিলাত প্রত্যাগত যাত্রীর কাছ থেকে শুনেছি যে মাত্র তিন দিন তথাকথিত কোয়ারেন্টাইনে থেকে নগদ নারায়ণের বদলে কোনরূপ টেস্ট ছাড়াই তাঁরা বেরিয়ে এসেছেন। যাদের দেহে বিলাতি বা দক্ষিণ আফ্রিকান স্ট্রেইন পাওয়া গেছে তাদের কোনো কন্টাক্ট ট্রেসিং হয়নি। আইইডিসিআরের পরিচালক তাহ্মিনা শিরিন বলেছেন যে গত ৩ সপ্তাহে অন্তত: ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষের করোনা হয়েছে। এতজন মানুষ কোথায় গেছেন, কার সাথে মিশেছেন (কন্টাক্ট ট্রেসিং) সেই হদিস বের করার মত জনবল তাদের নাই। কিন্তু শুরুতে তো এমন হাজার হাজার রোগী ছিল না। তখন তো রোগী ছিল শতের ঘরে। তখন কেন সেই হদিস বের করা হয় নাই?

॥ চার ॥
গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে শুরু করে ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল এই ১৩ মাসে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তদের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল গত ৭ এপ্রিল ৭ হাজার ৬২৬ জন, আর সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা পরদিন ৮ এপ্রিল ৭৪ জন। ৬ জানুয়ারি যখন প্রথম বৃটিশ ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয় তখন থেকে আসন্ন মহামারি মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়া হয়নি কেন? ৬ মাস আগেই তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগাম হুঁশিয়ারী সংকেত দিয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ২০২০ সালের প্যান্ডেমিকের চেয়ে এবারের প্যান্ডেমিক আরও ভয়ঙ্কর হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্যান্ডেমিকের সেই ভয়াল রূপটিই দেখছি। বিগত এক বছরে করোনা বেড বাড়ানো হয়নি কেন? এখন আইসিইউ এর তীব্র সংকট। আইসিইউ বেড বাড়ানো হয়নি কেন? করোনায় আক্রান্ত গরীব রোগীদের জন্য অক্সিজেন প্রাপ্তি তো সোনার হরিন। তার ওপর লাখ লাখ টাকার বিল। গরীব ও মধ্যবিত্তদের করোনা হলে আল্লাহর (সু:) ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নাই।

প্রিয় পাঠক, এবারের করোনা নিয়ে প্রতিদিন আপনারা মন খারাপ করা খবর পাচ্ছেন। সামনে কোনো ভাল খবর আশা করার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। যে রকম ন্যক্কারজনকভাবে পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করা হচ্ছে তাতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। লকডাউন জারির আগের দুই দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ রেল, বাস, লঞ্চ স্টিমারে গাদাগাদি করে দেশে গেছেন। এখন বাস চলছে, অফিস আদালত, দোকান পাট, কল কারখানা সবই চলছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে বাধ্য করার মত কঠোরতা সরকারের নাই। আমাদের মত কোটি কোটি সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা আল্লাহ্। তিনি যেন বাংলাদেশের মানুষকে রহম করেন।

Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/449270