৬ এপ্রিল ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:২৪

ডুবন্ত লঞ্চে সারি সারি লাশ

বাবা-মাকে হারিয়ে নির্বাক মাহিন

ডুবন্ত লঞ্চটি তীরে উঠানোর পর ভেতরে সারি সারি লাশ। মনে হচ্ছে আড়াআড়িভাবে তারা ঘুমিয়ে আছে। এক মা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে তার আদরের সন্তানকে। নিথর দেহ। একে একে ২৪টি লাশ বের করা হয় লঞ্চের ভেতর থেকে। এ সময় স্বজনদের আহাজারিতে ঘটনাস্থলের বাতাস ভারী হয়ে উঠে । হাউমাউ করে লাশের উপর আছড়ে পড়েন স্বজনরা। চিৎকার আর বুকফাটা আর্তনাদে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় সেখানে।

স্বজন হারানোর বেদনায় কেউ কেউ মূর্ছা যাচ্ছিলেন। সোমবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়লাঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের চিত্র এমনই ছিল। এর আগে রোববার রাতে ৫ নারী ও সোমবার সকালে এক বছরের শিশু আব্দুল্লাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯-এ।

রোববার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়লাঘাটে শীতলক্ষ্যা নদীতে একটি লাইটার জাহাজের ধাক্কায় ছাবিত আল হাসান নামে লঞ্চটি অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনাল থেকে যাত্রী নিয়ে মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছিল লঞ্চটি। ডুবে যাওয়া লঞ্চটির মালিকের নাম আলাল হোসেন। তিনি মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা।

নদী বন্দর নারায়ণগঞ্জের উপ-পরিচালক মোবারক হোসেন জানান, ৪৩ জন যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের দিকে রওনা হয়। চরসৈয়দপুর এলাকায় শীতলক্ষ্যায় নির্মাণাধীন সেতুর কাছাকাছি স্থানে অপর একটি জাহাজের ধাক্কায় দুর্ঘটনাটি ঘটে।

এদিকে লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার অভিযান শুরু করে। তবে কালবৈশাখী ঝড় ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার অভিযানে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু লঞ্চডুবির খবর ছড়িয়ে পড়লে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসে স্বজনরা। এরমধ্যে রাতে ৫ নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

ওদিকে নিখোঁজদের স্বজনরা শীতলক্ষ্যার পাড়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। রাতভর নদীর পাড়ে চোখের পানি ফেলেছেন তারা। কেউ মায়ের জন্য, কেউ সন্তানের জন্য, কেউ বাবার জন্য, কেউ ভাইয়ের জন্য আহাজারি করছিলেন। কে কাকে সান্ত্বনা দিবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন স্বজনরা। ভোর হতেই আবার শুরু হয় উদ্ধারকাজ।

সোমবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে তীরে টেনে তোলে। এরপর দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে প্রেস ব্রিফিং করে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

প্রেস ব্রিফিংয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ‘রোববার সন্ধ?্যা ৬টার দিকে একটি লাইটার জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়। এরপর থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড, দমকল বাহিনী, নৌ ও থানা পুলিশের উদ্ধারকর্মীরা। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।’নারায়ণগঞ্জ সদর ইউএনও নাহিদা বারিক স্বজনদের কাছে একে একে লাশগুলো হস্তান্তর করেন।

জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি নিহত পরিবারের জন্য ২৫ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আহতদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিকিৎসার ভার নেয়া হয়েছে।

নিহতের তালিকা
বিআইডব্লিউটিএ’র ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, নিহতরা হলেন- মুন্সিগঞ্জে কোর্টগাও এলাকার দোলা বেগম (৩৪), মুন্সীগঞ্জ সদরের রুনা আক্তার (২৪), মুন্সীগঞ্জের মোল্লাকান্দির সোলেমান বেপারী (৬০) ও তার স্ত্রী বেবী বেগম (৬০), মুন্সীগঞ্জের মালপাড়ার সুনিতা সাহা (৪০) ও তার ছেলে বিকাশ (২২), মুন্সীগঞ্জের উত্তর চর মসুরার পখিনা (৪৫), একই এলাকার বিথী (১৮) ও তার এক বছর বয়সী মেয়ে আরিফা, মুন্সীগঞ্জ সদরের প্রতিমা শর্মা (৫৩), মুন্সীগঞ্জের মোল্লাকান্দি চর কিশোরগঞ্জের মো. শামসুদ্দিন (৯০) ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৫), বরিশালের উটরা উজিরপুরের হাফিজুর রহমান (২৪), তার স্ত্রী তাহমিনা (২০) এবং এক বছর বয়সী শিশুপুত্র আবদুল্লাহ, মুন্সীগঞ্জের দক্ষিণ কেওয়ারের নারায়ন দাস (৬৫) ও তার স্ত্রী পার্বতী দাস (৪৫), নারায়ণগঞ্জের বন্দরের কল্যান্দী এলাকার আজমির (২), মুন্সীগঞ্জ সদরের শাহ আলম মৃধা (৫৫), একই এলাকার মহারানী (৩৭), ঢাকার শনির আখড়া এলাকার আনোয়ার হোসেন (৪৫), তার স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৩০) ও তাদের ৭ মাস বয়সী মেয়ে মানসুরা, মুন্সীগঞ্জ সদরের ছাউদা আক্তার লতা (১৮), শরিয়তপুরের নড়িয়ার আবদুল খালেক (৭০), ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার মোছা. জিবু (১৩), মুন্সীগঞ্জের খাদিজা বেগম (৫০), নারায়ণগঞ্জের বন্দরের সেলসারদীর মো. নয়ন (১৯) ও সাদিয়া (১১)।

দুই তদন্ত কমিটি
এদিকে লঞ্চডুবির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ ২টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। রোববার রাতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাহেরা খানম ববিকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে। অপরদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মো. রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট অপর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বাবা-মাকে হারিয়ে নির্বাক মাহিন: আমি এখন কাকে বাবা-মা বলে ডাকমু: ‘আমি বাবা কমু কারে, মা কমু কারে?’ আমি তো এতিম হয়ে গেলাম। মাথা চাপড়ে এভাবেই কাঁদছিল শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় মা-বাবা ও ছোট বোন হারানো মাহিন। তার আহাজারিতে আশেপাশে থাকা মানুষদের চোখও ভিজে উঠছিল। রোববার ছাবিত আল হাসান নামক লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জ থেকে মাহিনের নানীর বাড়ি মুন্সীগঞ্জ সদরের চর ক্যাওড়া হোগলারকান্দি যাওয়ার সময় কোস্টার জাহাজের ধাক্কায় অর্ধশতাধিক যাত্রীসহ লঞ্চটি ডুবে যায়। নিখোঁজ যাত্রীদের মধ্যে মাহিনের বাবা আনোয়ার শেখ ও মা মাকসুদার সঙ্গে ছিল ৮ মাস বয়সী তার ছোট বোন মানসুরা। নানীর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল শনির আখড়ার গোবিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মাহিনেরও। কিন্তু বাবার কথায় বাড়িতে থেকে যায় সে ও তার আরেক ছোট বোন মাহিয়া।
সোমবার সকালে স্বজনদের সঙ্গে শনির আখড়া থেকে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার চর সৈয়দপুর এলাকায় বাবা, মা ও ছোট বোন মানসুরার খোঁজে আসে মাহিন। পরে উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্য থেকে তার মা-বাবার লাশ শনাক্তের পর থেকেই মাথা চাপড়ে বার বার কাঁদছিলো মাহিন। আর বলছিলো, ‘আমি বাবা কমু কারে, মা কমু কারে?’।

দুপুর ২টায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ হস্তান্তরের পর দেখা যায় বাবা আনোয়ার শেখ ও মা মাকসুদার মরদেহ পেলেও ছোট বোনটির মরদেহ পায়নি মাহিন। দুপুর সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর মা ও বাবার মরদেহ নিয়েই শনির আখড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে মাহিন। সন্ধ্যার দিকে খবর পায় ছোট বোন মানসুরার লাশও উদ্ধার করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত রোববার সাবিত আল হাসান নামক লঞ্চটি ৫টা ৫৬ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। আনুমানিক সোয়া ৬টার দিকে এসকে থ্রি নামক একটি লাইটার জাহাজ নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার চর সৈয়দপুর এলাকায় পেছন থেকে লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তেই অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় লঞ্চটি।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=269068&cat=3