৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১০:৩৫

মিয়ানমারকে নিয়ে গ্রেট পাওয়ার গেম

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানে আমি মোটেই অবাক হইনি। বরং ঐ দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তথা জনগণের শাসন ফিরে আসার চিন্তাটাই আমার কাছে কেমন যেন মনে হয়। কারণ বুদ্ধি বয়স থেকেই শুনে আসছি একজন জেনারেলের নাম। তিনি জেনারেল নে উইন।

তখন খবরের কাগজ নিয়মিত পড়ার বয়স হয়নি। আমাদের বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। সম্ভবত: তখন টেলিভিশন চালুই হয়নি। তখন চলত মারফি রেডিও। বড়রা রেডিওর খবর শুনতেন। আমরা ছোটরা রেডিওতে শুধুমাত্র অনুরোধের আসরের গান শুনতাম। আর মেইন রোডের দোকানপাট গুলোতে হাই ভলিউমে রেডিও সিলোন থেকে হিন্দী গান বাজতো। যারা তরুণ বা পৌঢ় তাদের অনেকে জানেন না যে ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক ভারত যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে ভারতীয় হিন্দী ও বাংলা সিনেমা চলত। উল্টোরথ, সিনেমা জগত, নব কল্লোল প্রভৃতি ম্যাগাজিন সারা পূর্ব পাকিস্তানে চলত। অনেক ঘরেই তখন ভারতের ইংরেজী দৈনিক স্টেটস ম্যান, বাংলা দৈনিক যুগান্তর এবং আনন্দবাজার-এসব পত্রিকা রাখতেন। আমরা তখন এত ছোট ছিলাম যে ঐগুলো ইন্ডিয়ার পত্রিকা আর ইত্তেফাক, আজাদ-এগুলো পাকিস্তানের পত্রিকা-এতসব বুঝতাম না। আমার মামা চাকুরী করতেন বালুরঘাটে। জানতাম, দিনাজপুরে।

আসলে বালুরঘাট পশ্চিম দিনাজপুরে অবস্থিত। দিনাজপুর জেলা যে দুই ভাগ হয়ে একটি পূর্ব দিনাজপুর এবং আরেকটি পশ্চিম দিনাজপুর হয়ে গেছে সেটাই তখন বুঝতাম না। আমাদের আরেক আত্মীয় রেঙ্গুনে ছিলেন। সেখানে তিনি ব্যবসা করতেন। সেখান থেকে তিনি চাল পাঠাতেন। সেই চাল দিয়ে পোলাও হতো।

তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অনেকের বাসায় খাট পালঙ্ক বার্মার কাঠ দিয়ে বানানো হতো। এখন যেমন সেগুন কাঠ আভিজাত্যের প্রতীক সেদিন তেমনি বার্মা কাঠ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। তখন বার্মায় বাংলাদেশের অনেক মানুষ চাকুরী বাকুরী বা ব্যবসা বাণিজ্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান বার্মা দখল করে। ১৯৪৫ সালে বার্মা জাপানী দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে।

১৯৫৮ সালে জেনারেল নে উইন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন বার্মায় সামরিক শাসন জারী করেন। ১৯৮১ সালে জেনারেল নে উইন জেনারেল সান ইউয়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও তিনি বার্মার সোসালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির চেয়ারম্যান থেকে যান। তখন আসলে সামরিক বাহিনীর আড়ালে সোসালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টিই দেশ চালাচ্ছিল। এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে জেনারেল নে উইন একটানা ২৩ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সেজন্যই বলছি, ঐ ছোট বয়সে রাজনীতি বুঝি আর না বুঝি, বগুড়ায় বসেও জেনারেল নে উইনের নাম শুনেছিলাম।

তখন যেহেতু ছোট ছিলাম, রেগুলার পত্রিকা পড়ার বয়স হয়নি, জনগণও এখনকার মত অগ্রসর হয়নি, তাই জনগণের মাঝে যা ছড়িয়ে যেত তাই বিশ্বাস করতাম। তখন বার্মার রাজধানী ছিল রেঙ্গুন। পরবর্তীতে নাম বদলে হয় ইয়াঙ্গুন।

বর্তমান রাজধানী নেপিডো। যেমন রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল রাখাইন। আগে এর নাম ছিল আরাকান। আরাকানের মারমা ও রাখাইনদেরকে বলা হতো মগ। তাদের অধিকাংশ নদীপথে ডাকাতি ও লুণ্ঠন করতো। সে জন্যই কেউ জোর জবরদস্তি খাটালে বলা হয়, মগের মুল্লুক।

॥ দুই ॥
জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখলের পর রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচন্ড ছাত্র বিক্ষোভ হয়। সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করার ফলে অনেক ছাত্র এবং জনতা নিহত হয়। বগুড়ায় তখন আমরা গুজব শুনি যে সেনাবাহিনী রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। আরো শুনি যে সেনাবাহিনী বার্মায় কঠিন সমাজতন্ত্র কায়েম করেছে। এমন কঠিন যে পানের দোকান পর্যন্ত জাতীয়করণ করা হয়েছে। হয়তো এগুলো সবই ছিল রং চড়িয়ে বলা।
প্রিয় পাঠক, ওপরে এত কথা এজন্যই বললাম যে বার্মা বা মিয়ানমারে সামরিক শাসন নতুন কিছু নয়। সেই ছোট বেলা থেকে বার্মার মিলিটারী শাসনের কথা শুনে আসছি। এবারেও দেখলাম সামরিক শাসন। সুতরাং আমার কাছে এগুলো নতুন কিছু নয়। বরং বার্মায় সামরিক শাসন নাই, একথা শুনলেই তাজ্জব হয়ে যাই। যে দেশ ৭২ বছরের জীবনে ৫০ বছরেরও বেশি সময় সামরিক শাসনের অধীনে থাকে সেখানে এই ২০২১ সালে পুনর্বার সামরিক শাসন হলে তাজ্জব হওয়ার কি আছে।

এবার যেটা ঘটেছে সেটা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা লিপ্সার উলঙ্গ বহি:প্রকাশ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে, বিশেষ করে তাদেরকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রশ্নে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং অং সাং সূচীর ভূমিকায় কোনো তফাৎ নাই। এই প্রশ্নে সূচীর প্রতি বাংলাদেশের কোনো সহানুভূতি থাকার কথা নয়। কিন্তু নির্বাচনে ল্যান্ড স্লাইড্ ভিক্টোরির পর যেদিন পার্লামেন্ট সদস্যরা শপথ নেবেন তার আগের রাতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে বার্মার সামরিক জান্তা পৃথিবীতে একমাত্র গণচীন ছাড়া আর কোনো দেশকে কেয়ার করে না। আর বার্মাকেও সমর্থন করার ব্যাপারে চীনও কোনো ন্যায় নীতির ধার ধারেনা। তাই জাতিসংঘে বার্মার সামরিক জান্তার নিন্দা প্রস্তাবকে ব্লক করার ব্যাপারে চীন এইটুকু কুণ্ঠিত নয়।

প্রিয় পাঠক, বিশেষ করে এই অঞ্চলের রাজনীতি সচেতন মানুষ লক্ষ্য করেছেন যে বেশ কিছুদিন আগেও মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব তেমন একটা ছিল না। কিন্তু ৯০ দশক থেকে দেখা যাচ্ছে যে চীন মিয়ানমারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে যতই দিন যাচ্ছে ততই ভারতও বার্মার প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন করছে। বিষয়টি এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছে যে যখন বার্মাকে সমর্থনের ব্যাপারে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আরও লক্ষ্য করার বিষয় যে বার্মায় এমন নগ্নভাবে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে রাশিয়াও উচ্চকণ্ঠ নয়।

মিয়ানমারের প্রতি চীন, ভারত ও রাশিয়ার এই সফ্ট কর্নার বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অতীতেও দেখা গেছে, এখনও দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে রাশিয়া, চীন এবং ভারত কেউই সিরিয়াস নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে ভারত। সকলেই জানেন যে ভারত যা চেয়েছে বাংলাদেশ তাই দিয়েছে। ১২ বছর ধরে এই অবস্থা চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরৎ পাঠানোর ব্যাপারে ভারত একটি কথাও বলেনি। মাঝে মাঝে রোহিঙ্গাদের জন্য তারা কিছু রিলিফ পাঠাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এটাই কি বাংলাদেশকে ভারতের সমর্থনের নমুনা? তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত, রাশিয়া, চীন- কেউ বাংলাদেশকে সমর্থন করছে না কেন? কেন তারা সামরিক অভ্যুত্থানের পরেও মিয়ানমারকে সমর্থন করছে? কারণটি অতি পরিষ্কার। সেটি হলো আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে মিয়ানমার নিজেকে যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে তুলে ধরতে পেরেছে, বাংলাদেশ নিজেকে ততখানি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তুলে ধরতে পারেনি। কেন?

॥ তিন ॥
দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গোপসাগর ছিল ব্যাক ওয়াটারে। অর্থাৎ কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারও নিজেকে প্রকাশ করেনি। কিন্তু ৯০ দশক থেকে চীন যখন মিয়ানমারকে তার প্রভাব বলয়ে আনতে শুরু করে তখনই বিশ্বের অন্যান্য শক্তি নড়েচড়ে বসে। বিশ্বের বড় শক্তিগুলি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলির কাছে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। নীল পানির সম্পদ অর্থাৎ সাগর তলের এনার্জি সম্পদের সম্ভাবনায় মিয়ানমার প্রস্ফুটিত হতে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগর। কিন্তু মিয়ানমারের তটরেখা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড় এবং বিস্তৃত। তার ওপর চীন এখানে অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। ধারণা করা হয় যে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার তলদেশে রয়েছে বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস। অর্থনীতিবিদরা এটিকে বলেছেন ব্লু ওয়াটার ইকোনমি। পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা এবং আধিপত্য নিয়ে জাপানের সাথে চীনের বিরোধ। এই সমুদ্র এলাকার আধিপত্য নিয়ে মাঠে নেমেছে আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাথে নিয়েছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়াকে। এছাড়াও উপকূলবর্তী ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া-এসব নিয়েও চীনের বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে চাচ্ছে আমেরিকা।
ঠিক এই স্থানে এসে অকস্মাৎ অসাধারণ গুরুত্ব বেড়েছে মিয়ানমারের। উত্তর পূর্ব ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এই দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান খুব স্পর্শকাতর। মালাক্কা প্রণালী এবং হরমুজ প্রণালীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ায় মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূল তথা বঙ্গোপসাগর দুই মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। একটি হলো ভারত মহাসাগর, অপরটি হলো প্রশান্ত মহাসাগর। এছাড়া আঞ্চলিকভাবেও রয়েছে মিয়ানমারের গুরুত্ব। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংযোগ স্থলে অবস্থান মিয়ানমারের। উপকূলের পশ্চিম অংশে রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা। আর পূর্বাঞ্চলে রয়েছে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এমন ভূ-স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে বঙ্গোপসাগর এখন বৃহৎ শক্তি সমূহের রাডারে এসেছে।

এই কারণেই চীন এবং ভারত উভয়ই মিয়ানমারকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চায়। বস্তুত আপন আপন প্রভাব বলয়ে রাখার জন্য চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে।

মিয়ানমারের গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য ওপরে যেসব কারণ উল্লেখ করা হলো সেই সব কারণ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তার কূটনৈতিক তাস সফলভাবে খেলতে পারেনি। শুধুমাত্র ভারত নির্ভর হওয়ার কারণে চীনকে বাংলাদেশ ততখানি আকর্ষণ করতে পারেনি, যতখানি করতে পেরেছে মিয়ানমার। এই গেমে আরেকজন খেলোয়াড় হলো পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা। সেই একই ভূরাজনৈতিক কারণে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব প্রকাশ্যে সামরিক জান্তার বিরোধিতা করছে এবং অং সাং সূচীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলছে। আবার সেই একই কারণে চীন সামরিক জান্তাকে সমর্থন করছে। আসলে এটি মর্কিনী কূটনীতির ভাষায় একটি ‘গ্রেট বল গেম’। এখানে ন্যায় নীতির কোনো স্থান নাই। একমাত্র নীতি হলো, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’।
asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/443012