ফাইল ছবি
৯ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১:২২

সিন্ডিকেটের গুদামে সরকারি সার

চড়া দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক - চাঁপাইনবাবগঞ্জে অভিযানের পরও সক্রিয় পাচারকারীরা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার রাজবাড়ীহাটে ১০ ডিসেম্বর রাতে অভিযান চালায় গোয়েন্দা সংস্থা-এনএসআই। এ সময় গোপন গুদামে অবৈধভাবে মজুদ করা ১৫ লাখ টাকা মূল্যের এক হাজার ৪৮৫ বস্তা সরকারি সার জব্দ করা হয়। সার কালোবাজারির অভিযোগে মেসার্স মারুফ ট্রেডার্সের মালিক শফিকুল ইসলাম স্বপনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে অভিযান হলেও রাজবাড়ীহাটে বন্ধ হয়নি সার কেনাবেচার অবৈধ কারবার। প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাকভর্তি শত শত বস্তা ভর্তুকির সার রাজবাড়ীহাটে পাচার হচ্ছে। এখানে গড়ে উঠেছে পাচার সিন্ডিকেটের অন্তত চারটি বড় বড় গুদাম। এখান থেকেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এসব সার অবৈধ কারবারিদের হাতে যাচ্ছে। কৃষকরা এসব সারই কিনছেন চড়া দামে।

স্থানীয় বৈধ সার ডিলারদের অভিযোগ, রাজবাড়ীহাট জায়গাটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার সীমান্ত পয়েন্টে। ভর্তুকির সার টিএসপি, ডিএপি, এমওপি ও ইউরিয়া যশোরের নওয়াপাড়া, রাজশাহী, সান্তাহার ও পাবনার নগরবাড়ী থেকে কিনে এনে মজুদ করা হচ্ছে। বিসিআইসির এক শ্রেণির অসৎ ডিলার বরাদ্দ না তুলে চাহিদাপত্র বিক্রি করে দিচ্ছে সিন্ডিকেটের কাছে। এই এক সিন্ডিকেট থেকে আরেক সিন্ডিকেট হয়ে এসব সার বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই চলে যাচ্ছে রাজবাড়ীহাট সিন্ডিকেটের কাছে। সেখান থেকে খুচরা সার ব্যবসায়ীরা বেশি দামে সার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বস্তা প্রতি ১৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা বেশি দামে এসব সার বিক্রি করছে মাঠের কৃষকদের কাছে।

ডিলারদের আরও অভিযোগ, নাচোলের তরিকুল, তৈমুর ও শফিকুল ইসলাম স্বপনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে সার পাচারের সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে তরিকুল বিএডিসির বীজ ও সার ডিলার। তার মাসিক বরাদ্দ সামান্য। তবে তার ভাই তৈমুরের কোনো লাইসেন্স নেই। শফিকুল ইসলাম স্বপনেরও কোনো লাইসেন্স নেই। সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ এই তিনজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার সীমান্ত পয়েন্ট রাজবাড়ীহাটে গড়ে তুলেছে চারটি বড় গুদাম। সন্ধ্যার পর প্রতিদিন ট্রাকভর্তি শত শত বস্তা সরকারি সার অবৈধভাবে এনে এসব গুদামে মজুদ করা হচ্ছে। এসব সার দিনের বেলায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে। গত কয়েক মাস ধরে এই সিন্ডিকেট রমরমাভাবে পাচার সারের কারবার চালালেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অথবা নওগাঁ জেলা ও উপজেলা সার মনিটরিং কমিটি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। পাচার হয়ে আসা সারের এই অবৈধ কারবারের ফলে এই দুই জেলার বৈধ সার ডিলাররা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন বেশি দামে সার কিনতে। পাশাপাশি সার বিতরণে সৃষ্টি হয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা।

ডিলারদের অভিযোগে আরও জানা গেছে, নাচোল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বুলবুল আহম্মেদ এই পাচার সিন্ডিকেটের অবৈধ কারবারে সহযোগিতা করছে। যদিও বুলবুল সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এনএসআই ১০ ডিসেম্বর রাজবাড়ীহাটে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সার জব্দ ও পাচারকারীদের অন্যতম শফিকুল ইসলাম স্বপনকে গ্রেফতার করলেও সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে সে আবারও সার পাচার ও মজুদে লিপ্ত হয়েছে। মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় সার পাচারের এই রমরমা কারবার চলছে বলে কৃষকদের অভিযোগ।

জানা গেছে, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৮৫০ হাজার টাকার বস্তার (৫০ কেজিতে বস্তা) টিএসপি এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা, ৮০০ টাকার ডিএপি এক হাজার থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা, ৭৫০ টাকার এমওপি বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা করে। এ ছাড়া ৮০০ টাকা বস্তার ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। সার বিক্রিতে কৃষককে ক্যাশমেমো দেওয়ার কথা থাকলেও কোথাও কোনো কৃষককে মেমো দেওয়া হচ্ছে না। কার কাছে কী পরিমাণ সার বিক্রি করা হচ্ছে তার রেকর্ডও রাখা হয় না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শাজাহানপুর নতুনপাড়া গ্রামের কৃষক মহিদুল ইসলাম জানান, ভরা আবাদ মৌসুমে টিএসপি, ডিএপি, এমওপি এবং ইউরিয়া পাওয়া যাচ্ছে না বিএডিসি অথবা বিসিআইসির ডিলারদের কাছে। ফলে বেশি দামে খুচরা দোকান থেকে বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। তানোরের লালপুর গ্রামের কৃষক শরিফুল ইসলাম জানান, সরকারি সার নিয়ে চরম অরাজকতা চলছে তানোরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের নাচোল, নিয়ামতপুর, পোরশা, মান্দা, সাপাহারসহ বিভিন্ন এলাকায়। বস্তাপ্রতি ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যস্ত বেশি দামে সার কিনছেন কৃষকরা। এই বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সার পাচার ও অবৈধ মজুদের মোকাম রাজবাড়ীহাট জায়গাটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর সীমান্তবর্তী পয়েন্ট। মজুদের গুদামগুলো নিয়ামতপুর উপজেলা এলাকাতে করা হয়েছে যেন আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে না পারি। আমরা ইতোমধ্যে নিয়ামতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সার পাচার ও মজুদ ঠেকাতে নজরদারির অনুরোধ করেছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/382062/