৮ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১০:৪৭

বাড়তি দশ লাখ জনশক্তি পাঠানোর চাপ নিয়ে নতুন বছরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়

ইবরাহীম খলিল : করোনা ভাইরাসের কারণে চাকরি হারিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। এছাড়া যারা বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিলেন লকডাউনের মধ্যে তারাও যেতে পারেননি। যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ লোক বিদেশে যেতেন, সেখানে করোনার কারণে চলতি বছর তা হাজারের ঘরে নেমে এসেছে। আবার যারা ফেরত এসেছেন তারাও জোর তদবির করছেন কর্মস্থল বিদেশে যাওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে দশ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানোর চাপ নিয়ে নতুন বছর শুরু করতে যাচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে বিশ্বের এই পরিস্থিতি ঠিক হতে কয়েক বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে মাত্র ৮ হাজার বিদেশ গিয়েছেন। যেখানে অন্যান্য বছরগুলোতে এই সময়ে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে যেতো। আগের বছরগুলোতে যেখানে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ লাখ শ্রমিককে বিদেশে পাঠানো হতো। সেখানে চলতি বছর বিদেশে পাড়ি জমাতে পেরেছেন ১ লাখ ৯০ হাজারের মতো মানুষ। যাদের ৯৬ শতাংশ গেছে প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার আগে। এর মধ্যে এপ্রিল-জুন পর্যন্ত লকডাউনের কারণে একজনকেও পাঠানো যায়নি। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে গিয়েছে মাত্র ৮ হাজার অভিবাসী।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৭-৮ লক্ষ লোক বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে গমন করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে ৭,০০,১৫৯ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মহামারি করোনা ভাইরাস ও বিভিন্ন গন্তব্য দেশের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বৈদেশিক কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। এই করোনা মহামারির পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় দেশে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের আর্থ সামাজিক রিইন্ট্রিগ্রেশন সহ সামগ্রিক সুরক্ষা, বর্তমান শ্রমবাজার ধরে রাখা, নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান, বন্ধ শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণসহ করোনাত্তর পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরিকে প্রাধান্য দিয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ বলেছেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমনের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক শ্রমবাজার প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ একটি চ্যালেঞ্জ। তারপরেও আমরা আশাবাদী। রাতের পর দিন আসে। তেমনিভাবে অর্থনৈতিক মন্দার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কর্মী নিয়োগকারী দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অবশ্যই কর্মী প্রয়োজন হবে এবং শ্রমবাজার আবার স্বাভাবিক হবে। এই প্রত্যাশায় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে আমরা আমাদের কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সার্টিফিকেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।

বিদেশে কর্মহীন হয়ে পড়া বাংলাদেশী কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও তাদের লব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সনদ প্রদানের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে গ্রীসে মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা উন্নয়ন তহবিলের অর্থায়নে একটি প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু হয়েছে। বাহরাইন ও সৌদি আরবে অনুরূপ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

করোনাত্তর আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী পুনঃপ্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে ফেরত আসা কর্মীদের পুনরায় বিদেশ প্রেরণের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ সচিব। এছাড়া, প্রশিক্ষণের যথাযথ সনদায়ন ও পূর্ববর্তী শিক্ষার স্বীকৃতি বিষয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে জচখ সনদ প্রদানের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ফেরত আসা শ্রমিকদের কি হবে?

সৌদি আরব থেকে জুলাই মাসে ফেরত এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজল। ভাগ্য বদলের আশায় সৌদি আরব গেলেও সেখানে গিয়ে তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। শেষে তাকে আউটপাস দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। কাজল জানান, বিমানবন্দর থেকে বাড়ি যাওয়ার টাকা আমার কাছে ছিল না। বিভিন্ন সংস্থা থেকে ব্যবস্থা না করলে আমি ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াও পৌঁছতে পারতাম না।

ছুটিতে দেশে এসে আটকে পড়া প্রায় ১২ হাজার প্রবাসী কাতার ফেরত যেতে চান। ফেরত যেতে চান সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশ থেকে ফেরত আসা মানুষগুলো। এজন্য রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান করে বিভিন্ন দাবি জানান প্রবাসীরা। দাবি আদায়ে প্রয়োজনে সৌদি প্রবাসীদের মতো বিক্ষোভ কর্মসূচির হুমকিও দেন তারা।

চাঁদপুরের কাতার প্রবাসী ইসমাইল হোসেন বলেন, ১২ থেকে ১৩ মাস কাতার প্রবাসীরা আটকে আছেন। তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সরকার কিংবা কোনো এনজিওর পক্ষ থেকে আমাদের কোনো সাহায্য করা হয়নি। নতুন এন্ট্রি পারমিট পদ্ধতির কারণে আমরা দেশে আটকে পড়েছি। অতি শিগগিরই কাতার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য এই পদ্ধতি সহজ করার দাবি জানাই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি কাতার সরকারের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে সফর করে তারা যেন এন্ট্রি পারমিট নামক বিকল্প পদ্ধতি সহজ করার পদক্ষেপ নেয়।

ভুক্তভোগীরা জানান, আমাদের রি-এন্ট্রি পারমিট সহজ করে দিলে আমরা বিদেশে যেতে পারবো। আমরা করোনার কারণে ছুটিতে এসে কেউ ১১ মাস, কেউ ১২ মাস আটকে আছি। রি-এন্ট্রি পারমিট সহজ করতে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক প্রয়োজন। তারা বলেন, ৯৫ শতাংশ কাতার প্রবাসীর ভিসার মেয়াদ শেষ, বিগত ৪ মাস ধরে আমরা রি-এন্ট্রির মাধ্যমে আবেদন করছি, কিন্তু আমাদের আবেদন নিচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে করোনার প্রকোপ অনেক বেশি অথচ সেখান থেকে কাতারে যাচ্ছে সে দেশের শ্রমিকরা।

করোনা মহামারির মধ্যে সারা বিশ্বের সাধারণ বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকার পরও দেশে ফেরা সোয়া ৩ লাখ বাংলাদেশির প্রায় সবারই একই অবস্থা। এদেশের বেশির ভাগই সহায় সম্বল হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। কেউ মহামারির কারণে কর্মহীন কিংবা চাকরির চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় দেশে ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া কেউ কেউ বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে বা সাধারণ ক্ষমার আওতায় দেশে ফেরত এসেছেন।

https://dailysangram.com/post/439909