৭ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:৫০

এক বছর নির্বিঘ্নে পার করলেন ঋণখেলাপিরা

ঋণখেলাপিদের কাছে বিদায়ী বছরটি ছিল মধুময় বছর। ঋণ পরিশোধের কোনো চাপ ছিল না। ছিল না কোনো তাগিদ। অসাধু ব্যাংকারদের সাথে যোগসাজশ করে খেলাপি ঋণ লুকাতে কোনো কৌশলও অবলম্বন করতে হয়নি। তাই ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা অনেকটা নির্বিঘেœই পার করলেন একটি বছর।

গেল বছরের মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর একসাথে রফতানি আদেশ বাতিল হতে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই তা স্থগিত হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। এমনি পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়, ঋণ পরিশোধ না করলেও সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। গত ১৯ মার্চ এক সার্কুলারের মাধ্যমে এ নির্দেশনা দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববাণিজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমদানি-রফতানিসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের কারণে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে অনেক ঋণগ্রহীতাই সময়মতো ঋণের অর্থ পরিশোধে সক্ষম হবেন না বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এতে চলমান ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এবং দেশে সামগ্রিক কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবেÑ এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, গত ১ জানুয়ারিতে ঋণের শ্রেণীমান যা ছিল, ৩০ জুন পর্যন্ত ওই মানেই রাখতে হবে। এর চেয়ে বিরূপ মানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৯ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করা হলো।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, প্রথমে এ নির্দেশনা ৩০ জুন পর্যন্ত ছিল। পরে আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। করোনা পরিস্থিতি তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারের কার্যকারিতা গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টেনে আনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নির্দেশনায় প্রকৃত ব্যবসায়ীরা উপকৃত হলেও, ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিদের জন্য ছিল আরো বেশি স্বস্তিদায়ক। কারণ ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা একবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারলে তা আর সহজে পরিশোধ করেন না। নানা কৌশল অবলম্বন করে দিনের পর দিন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যান। এ জন্য কখনো উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নেন। আবার কখনো কখনো অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগাসজশে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ পরিশোধ দেখানো হয়। এভাবে ঋণ নিয়মিত করে আবারো ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নেন। কখনো কখনো কোনো ঋণ পরিশোধ না করে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়ন করেন। কখনো নাম মাত্র ১ বা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করেন। কিন্তু গত এক বছর ঋণ পরিশোধের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড় দেয়ায় ইচ্ছেকৃত ঋণখোপিরা অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কোনো রকম দুশ্চিন্তা বা কৌশল অবলম্বন ছাড়াই অর্থাৎ এক টাকা ঋণ পরিশোধ না করেই নির্বিঘেœ পার করে দেন বছরটি।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা বরাবরই সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। ঋণ পরিশোধ না করে কিভাবে পার পাওয়া যায় সেই চেষ্টায় থাকেন। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিরা ঋণ নবায়ন করে নেন। তখন ১৫টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ ১৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণ নবায়ন করেন। এর পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাতারাতি খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার জন্য কোনো রকম ডাউন পেমেন্ট না নিয়েই ঋণ নবায়ন করার সুযোগ করে দেয়। ওই বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ দুই সপ্তাহে কিছু কিছু ব্যাংক শুক্রবারেও পর্ষদ বৈঠক ডেকে শত শত কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করে কোনো রকম ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে ১৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে ঋণখেলাপিকে। এর পর গত ২০১৯ সালেও ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ও বিদ্যমান সুদহারে ছাড় দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়। সর্বশেষ গেল বছর জুড়েই কোনো রকম ঋণ পরিশোধ না করেই পার পেয়ে যান খেলাপিরা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঢালাওভাবে ছাড় না দিয়ে শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের এ সুযোগ দিলে ব্যাংকের আদায় কিছুটা হলেও বাড়ত। কারণ করোনা প্রাদুর্ভাব চলাকালীন ওষুধ শিল্পসহ আরো বেশ কিছু খাতের ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসা করেছেন। তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন; কিন্তু ভালো ব্যবসা করার পরেও তারা ছাড় পেয়ে যান। এতে ব্যাংকের প্রকৃত ঋণ আদায় কমে গেছে। অনেকেই ভুয়া মুনাফা করার সুযোগ পেয়েছেন। কিছু কিছু ব্যাংকের বেড়ে গেছে কৃত্রিম মুনাফা। এতে ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিদের প্রকৃতপক্ষেই আইনের আওতায় আনা হলে ব্যাংকের ঋণ আদায় যেমন বাড়ত, তেমনি অর্থপাচারও কমে যেত।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/554070/