ঘরে ঢুকে শিশুসন্তানসহ চারজনকে গলা কেটে হত্যা; ডোবায় দুই সন্তানসহ মায়ের লাশ; রাস্তায় দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যা; গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যা; পাওনা টাকা চাওয়ায় হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রের লাশ বিকৃত; কিংবা দুই ছেলে মিলে বাবাকে হত্যা, পাহারায় স্ত্রী!—দেশে এ ধরনের নৃশংস ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। তুচ্ছ কারণেও স্বজনদের হাতে খুনের ঘটনা ঘটছে। আর্থিক লেনদেন ও সম্পর্কের বিরোধেও কেউ হয়ে উঠছে ভয়ংকর খুনি।
অপরাধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পারিবারিক সহিংসতা ও সংঘবদ্ধ অপরাধে হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে করোনাকালে নৃশংসতার ঘটনা বেড়েছে। চোর, ছিনতাইকারী, ডাকাতসহ পেশাদার অপরাধীরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ধর্ষণ-নিপীড়ন নিয়ে আন্দোলনের আগে-পরে গত এক মাসে সারা দেশে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ছাড়া ছিনতাই, চুরি, বিদেশিদের প্রতারণা, ফেসবুকে প্রতারণা, জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, ধর্ষণের সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতা, হত্যার মতো নিষ্ঠুর ঘটনা বাড়ছে। অপরাধ, সমাজ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় ঘরবন্দি থাকার পর আর্থিকসহ জীবনের বিভিন্ন ধরনের হতাশা-সংকটে মানুষের হিংস্রতা বাড়ছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সংঘবদ্ধ অপরাধীরাও সুযোগ খুঁজছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনসম্পৃক্ততা এবং সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তবে পুলিশের সংখ্যাগত অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্চ-এপ্রিল মাসে অপরাধ কমে পরবর্তী সময়ে বাড়লেও তা বিগত সময়ের তুলনায় কমই আছে। পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে সাতক্ষীরার কলারোয়ার হেলাতলা ইউনিয়নের খলসি গ্রামে মাছের ঘের ব্যবসায়ী শাহিনুর রহমান, তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। খুনিরা জীবিত রেখে যায় ছয় মাস বয়সের শিশু মারিয়াকে। গতকাল শাহিনুরের ছোট ভাই রায়হানুলকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক বা জমিসংক্রান্ত বিরোধে পরিচিতরাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। একই দিন ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলের ধর্মগড় ইউনিয়নের ভরনিয়া শিয়ালডাঙ্গী গ্রামে ডোবা থেকে মাসহ দুই সন্তানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঋণের টাকা নিয়ে ঝগড়া ও কথা-কাটাকাটির জেরে এই রহস্যঘেরা মৃত্যুর ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই দিনই যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জয়ন্তা গ্রামে রাস্তায় দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ডিশ ব্যবসার বিরোধে এই খুন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর হাজারীবাগের বসিলায় লাল মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে তাঁর ছেলেরা বাসার ভেতরে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। হামলার সময় তাঁর স্ত্রী আরজুদা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দেন। পুলিশ জানায়, আগের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আরেকটি বিয়ে করতে চাওয়া এবং ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে বিরোধে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। গত রবিবার মাগুরার নবগঙ্গা নদী থেকে তালের ডোঙার সঙ্গে বাধা অবস্থায় মাহিদ মোল্লা নামে একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। মাহিদের বাবা মজিরুল তাঁর চাচাতো ভাইয়ের ছেলেকে মারধর করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ১৫ বছরের ওই কিশোর মাহিদকে হত্যা করে নদীতে ডুবিয়ে দেয়। বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের হাওরের ইটনা উপজেলায় নৌকার সঙ্গে ধাক্কা লাগার কারণে গাজী মিয়া নামের এক মাঝিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে কয়েকজন। গত সোমবার রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে উদ্ধার করা হয় চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র আজিজুল ইসলাম মেহেদীর লাশ। পাসপোর্টের নাম সংশোধনের কাজের জন্য বাল্যবন্ধু আহসান এবং পরিচিত আলাউদ্দিনকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কাজ না হওয়ায় টাকা ফেরত চাওয়ায় ঘনিষ্ঠরাই তাঁকে ডেকে এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর হাজারীবাগের বটতলার বোরহানপুরের বাড়িতে জাবেদ হাসান নামের এক ব্যবসায়ী দুই শিশুসন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এই মর্মান্তিক ঘটনায় জারিন হাসান রোজা (৬) নামে তাঁর এক সন্তান প্রাণ হারায়। পুলিশ ও স্বজনরা জানায়, ঋণ ও দাম্পত্য কলহের হতাশা থেকে জাবেদ এই নির্মম ঘটনা ঘটান। গতকাল শুক্রবার মেহেরপুরের গাংনীতে এক গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে।
সহিংসতা বাড়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে মানুষের চাকরি তথা রিজিকে হাত পড়েছে। এটা আরো দীর্ঘ হলে সমাজে বেকারের সংখ্যা বাড়তে পারে। বিশেষ করে অভাবী মানুষের জমানো টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা অস্থির হয়ে ওঠে। তারা আয়-রোজগারের জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠলে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এর জন্য প্রশাসনকে বিশেষভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান আবদুল কাদের মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনায় একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কারণে অপরাধ সাময়িক কিছুটা কমেছিল, এতে স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই। মানসিক অস্থিরতা থেকে এবং আর্থিক কারণে অনেকে অপরাধ করতে শুরু করবে। ধৈর্যচ্যুতির কারণে অল্পতেই সহিংস হয়ে উঠছে মানুষ। এখন আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে পুলিশকে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। কমিউনিটিকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মোহিত কামাল বলেন, হতাশা থেকে রাগ এবং ধৈর্য হারানোর ঘটনা ঘটছে এখন। এটা ব্যক্তিত্বের ওপরও নির্ভর করে। হতাশার কারণে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। কারো কারো অপরাধ মনোভাব তৈরি হতে পারে। হতাশা দূর করতে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যায়ামগুলো করা দরকার। সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং জীবিকা নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও প্রয়োজন।
সম্প্রতি পুলিশ হেফাজতে টাকা আদায়ের জন্য নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগেও তোলপাড় চলছে। গত শনিবার মধ্যরাতে রায়হান নামের এক যুবককে সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করে পরিবার। সকালে তিনি মারা যান। গত মঙ্গলবার ঢাকার নবাবগঞ্জের হাজতের টয়লেট থেকে মামুন নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত মাসে সিলেটে এমসি কলেজে গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর চলতি মাসে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ পেলে ধর্ষণ-নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, চলতি বছরের ৯ মাসে ৯৭৫ জন, যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হন ৭৬২ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২০৮ নারী। ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ নারী।
গত জুন মাসে দেশের ৫৩টি জেলার মোট ৫৭ হাজার ৭০৪ জন নারী ও শিশুর ওপর জরিপ চালিয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। তাতে দেখা যায়, গত মার্চ থেকে প্রতি মাসে পারিবারিক সহিংসতা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। মে মাসে নির্যাতনের এই সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৪৯৪। এর মধ্যে ১১ হাজার ২৫ জন অর্থাৎ ৯৭.৪ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৯ শতাংশ, অর্থাৎ দুই হাজার ৮৫ জন।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, অতীতের হিসাবে দেশে প্রতি মাসে গড়ে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। দিনে কমপক্ষে চারটি। সে হিসাবে এখন হত্যাকাণ্ডসহ নৃশংস অপরাধ বাড়েনি। করোনাকালে অন্যান্য অপরাধের মামলা কমলেও এখন বাড়ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে জানুয়ারি মাসে ১৮ হাজার ছয়টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৭ হাজার ৪৭২টি, মার্চে ১৭ হাজার ১৫০টি, এপ্রিলে ৯ হাজার ৯৮টি, মে মাসে ১১ হাজার ৫০০টি মামলা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) মো. সোহেল রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশ বখাটে, কিশোর গ্যাং ও ইভ টিজারদের বিরুদ্ধে সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। আবার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেও নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরের নজরে আসার পরই সচেতনতা, নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
https://www.kalerkantho.com/online/national/2020/10/17/966371