২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ৪:৩৯

তখন মানুষের মৃত্যুভয় থাকে না

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : পবিত্র কুরআন সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা শুরুতেই মানবজাতিকে সচকিত করে ঘোষণা করেন, ‘জালিকাল কিতাবু লা রাইবা; ফিহ।’ অর্থ: এটি এমন এক কিতাব (বিধান), যার মধ্যে কোনওপ্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি নেই। -সুরা বাকারা : ২য় আয়াতের ১ম অংশ।

কুরআন নাযিলের আগেও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এরপর প্রায় আরও ১৪ শত বছরের অধিক কাল ধরে পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। এগ্রন্থসমূহের সব ফেলে দেবার মতো নিশ্চয়ই নয়। মানে এসব গ্রন্থ বা কিতাব মানবরচিত হলেও এর অনেকগুলোতে মূল্যবান কথা, তথ্য বা বিবরণ নিশ্চয়ই আছে বা ছিল। কিন্তু সেগুলোর সিংহভাগই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কোটি কোটি গ্রন্থ বা কিতাবের নাম-গন্ধও জানে না এখনকার মানুষ। এছাড়া যেগুলো এখন পর্যন্ত টিকে আছে সেগুলোর ব্যাপক সংস্কার, সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। কিন্তু আল্লাহর কিতাব আল কুরআনের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই। সংস্কার নেই। চেইনজ নেই। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর নবুয়তি জিন্দেগির ২৩ বছরে কুরআন যেভাবে নাযিল হয়েছিল হুবহু ঠিক সেভাবেই সমগ্র দুনিয়াজুড়ে আজও জারি রয়েছে। শুধু কি মানুষের লেখা গ্রন্থই বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে? না। হযরত মুহাম্মদ (স) এর পূর্ববর্তী নবী-রসুলদের কাছে যেসব আসমানি কিতাব নাযিল হয়েছিল সেগুলোর একটিও আস্ত নেই। থাকবার কথাও নয়। তার কারণ হচ্ছে, সর্বশেষ কিতাব বা আসমানি বিধান নাযিলের পর পূর্বেকার সমস্ত কিতাব বা বিধান স্থগিত বা বাতিল হয়ে গেছে।

‘এ কিতাবে কোনওপ্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি নেই।’ মানুষের লেখা কোনও একটি গ্রন্থের শুরুতেই এভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার দুঃসাহস করেছেন কোনও লেখক বা গ্রন্থপ্রণেতা? নিশ্চয়ই না। বরং প্রত্যেক গ্রন্থকারই বইয়ের শুরুতেই উল্লেখ করে দেন, ‘ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কোনও পাঠক অনুগ্রহ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরবর্তী সংস্করণে তা শুধরে নেবার চেষ্টা করবো।’ অর্থাৎ মানুষের কোনও কাজই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। এটাই স্বাভাবিক।

পৃথিবীতে ১০-২০ পৃষ্ঠার কোনও একটি বইয়ের কোথাও হাফিজ আছেন কি কেউ? অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ অবধি কুরআন ব্যতীত অন্য কোনও গ্রন্থ কেউ মুখস্থ করে রেখেছেন? মনে হয় নেই। কারণ তা সম্ভব নয়। কিন্তু পবিত্র কুরআনের ৬ কোটিরও বেশি সংখ্যক হাফিজ রয়েছেন বলে এক তথ্যে প্রকাশ। আলহামদুলিল্লাহ।

প্রতিদিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যারা এর জের, যবর, পেশ, নোকতা অর্থাৎ বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে কণ্ঠস্থ করেছেন। এমনকি ৪-৫ বছর বয়সের শিশুরাও ত্রিশপারার বিশাল কিতাব পুরোপুরি মুখস্থ করে ফেলে। তাও অর্থ না বুঝেই।

লাখ লাখ শিশু পুরো কুরআন হিফজ করে মাত্র ৩-৪ মাসে। আবার অসংখ্য অন্ধ হাফিজও রয়েছেন পৃথিবীতে। কুরআন ব্যতীত এমন নজির আর আছে কি? তাই আল্লাহর কালাম কুরআনের চাইতে অলৌকিকতা আর কী হতে পারে?

পৃথিবীর সমস্ত ছাপা কুরআন, ক্যাসেট, হার্ডডিস্ক আগুনে পুড়ে ছাই করে ফেললেও এর কপি হাফিজদের কাছ থেকে সহজেই পাওয়া যাবে। অন্য কোনও গ্রন্থের এমনটি প্রায়ই অসম্ভব। কারণ মানবপ্রণীত কোনও গ্রন্থই হুবহু কারুর মুখস্থ নেই।

উল্লেখ্য, প্রায় ১৪ শত বছর আগের তুলির সাহায্যে লেখা আর বর্তমান কম্পিউটার যুগের কুরআনের মধ্যে বিন্দুমাত্র ফারাক নেই। এমন উদাহরণ আর কী আছে?

এর কারণ হচ্ছে, কুরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। এর সংরক্ষক আল্লাহ নিজে। পবিত্র কুরআনের মতো এমন অলৌকিক নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

পৃথিবীর বহু পণ্ডিত পবিত্র কুরআনের খুঁত ধরতে এসে পরিশেষে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছেন প্রতিদিন। এমন ঘটনা ঘটছে প্রায় রোজ ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে বেশি। কুরআনের ত্রুটি খুঁজতে এসে যারা কোনও ত্রুটিতো পাননি; বরং এর নির্ভুলতা আর অলৌকিকতায় বিমুগ্ধ ও বিমোহিত হয়ে পড়েছেন তওহিদের পবিত্র কালেমা; তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ আসাদ, মরিস বুকাইলি, মারমাডিউক পিকথল উল্লেখযোগ্য।

কুরআন নাযিলের সময়কালে আরবের কবিরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিলেন যে, কুরআনের মতো তাঁরাও নিখুঁত বাণী লেখতে সক্ষম। আল্লাহও তাঁর রাসুল (স) এর কাছে ওহির মাধ্যমে জানান, ঠিক আছে। ওরা লেখুক। কিন্তু আরবের সবকবি একসঙ্গে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলতে বাধ্য হন, এ হলো আসলেই মহান আল্লাহর বাণী।
কুরআন যে আল্লাহর বাণী তা বহুভাবে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর কোনও পণ্ডিত এতে সামান্যতম ভুল খুঁজে পাননি। পাবার উপায়ও নেই।

উল্লেখ্য, কুরআন শুধু মুসলিমদের নয়। এ কিতাব সমগ্র মানবজাতির এক মহাসম্পদ। এর আলোয় আলোকিত হবার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক মানুষের। এ কিতাব শুধু মুসলিমরাই পড়বে এমন নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই এ কিতাব নির্দ্বিধায়, নির্বিঘ্নে অধ্যয়ন করতে পারেন। পাঠ করতে পারেন। পারেন এর মর্ম উপলব্ধি করতে।

হেরাগুহায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় প্রথম যে ওহি নাযিল হয়েছিল তা কী ছিল জানেন নিশ্চয়ই। ছিল ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক।’ অর্থ : পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। এই যে ‘পড়ুন', এর তাৎপর্য হচ্ছে মানুষকে পড়তে হবে। অধ্যয়ন করতে হবে। বিদ্যার্জন ব্যতীত কল্যাণ যেমন নিজের জন্য সম্ভব নয়, তেমনই অন্যের জন্যও তা সম্ভব নয়। পড়া বা শিক্ষাই হচ্ছে উন্নয়ন ও সভ্যতার চাবিকাঠি। পড়া বা শিক্ষার মধ্যেই মানবতার প্রকৃত মুক্তি। তাই প্রথম ওহি বা কুরআনের প্রথম বাণীই হলো ‘ইকরা’ বা পাঠ করুন। কিন্তু ভারতীয় ধর্মগ্রন্থসমূহ বিশেষ শ্রেণির পুরুষ ব্যতীত অন্যদের জন্য পঠনপাঠনসহ শ্রবণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। তাই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল ভারতীয় ধর্মগ্রন্থসমূহ। কিন্তু কুরআন অধ্যয়ন, পঠনপাঠন সবশ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত। কুরআন সব মানুষের কাছে খোলামেলা।
অনেকে মনে করেন কুরআন কেবল মুসলিমদের জন্য। কোনও কোনও মুসলিমেরও এমন ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আসলে তা ঠিক নয়। কুরআন সবমানুষের জন্য নাযিল হয়েছে। পৃথিবীর আলো-বাতাস, খাদ্য-পানীয়তে যেমন সমান অধিকার, তেমনই পবিত্র কুরআন আল্লাহর তরফ থেকে একটি বিশেষ রহমত ও নিয়ামত। এ কিতাব কোনও জাতির একক সম্পদ নয়। সূর্যের আলো যেমন সবার জন্য উন্মুক্ত, তেমনই কুরআনের জ্ঞান অর্জনসহ এ থেকে সবমানুষই ফায়দা নিতে পারেন।

যারা এ চিরশাশ্বত নিয়ামত থেকে বঞ্চিত তারা সত্যিকার অর্থেই হতভাগ্য।

হটকারিতা নয়, বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে নয়, কোনও ভাবাদর্শে আপ্লুত বা আবেগতাড়িত হয়ে নয়, গভীর আন্তরিকতা ও ঔদার্য নিয়ে এসব কথা ভাবুন। তাহলেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতের দুয়ার খুলে যাবে সহসাই।

বৃটিশ সংস্থা ‘ফেইথ ম্যাটার্স’ এর গবেষণা জরিপে উল্লেখ করা হয় যে, সম্প্রতি শুধু বৃটেনে ১০ বছরে ৪০ হাজারের অধিক তরুণ-তরুণী পবিত্র কালেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। আসলে কুরআনই পারে মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতের দুয়ার খুলতে। যখন কেউ পবিত্র কালেমার প্রকৃত তাৎপর্য ও মর্মার্থ মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে পারেন তখন তাঁর জীবন বিপন্ন হলেও তা আঁকড়ে থাকেন। ফাঁসিতে ঝুলতেও দ্বিধা করেন না। অর্থাৎ মৃত্যুভয় তাঁর থাকে না। কালেমার দাবির কাছে মানুষের জীবন অতি তুচ্ছ এবং নগণ্য প্রতিপন্ন হয়।

https://dailysangram.com/post/428643