১৮ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ৫:৩৯

ঝুঁকিপূর্ণ সারাদেশ

মহামারীর মধ্যে ঢুকে গেছি আমরা : প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হার্ডলাইনে না যাওয়ায় লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না : ড. এম সাখাওয়াত হোসেন

করোনাভাইরাসে ঝুঁকিপূর্ণ এখন সারাদেশ। পরীক্ষা ও প্রস্তুতিতে বিলম্ব, এবং বিদেশফেরত প্রবাসী, ঢাকায় কর্মরত গার্মেন্টস শ্রমিকরা সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি আরো বেগে গেছে। সনাক্তকরণ ও রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে তোড়জোড় মিডিয়ার খবরে প্রচার করা হলেও বাস্তবে এখনো অনেক প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ। ডাক্তার-নার্সরাই এখনো কার্যত অরক্ষিত। প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার চল্লিশতম দিনে দেশের কমপক্ষে ৪৩টি জেলায় সংক্রমিত রোগী পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশ এরই মধ্যে মহামারীর পর্যায়ে চলে গেছে। চোখ রাঙাচ্ছে পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার।

জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ান উর রহমান বলেন, ভয়াবহ মহামারীতে আমরা উপরের দিকে উঠছি। আস্তে আস্তে উঠতে থাকবো। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাস্তায় আছে কিন্ত হার্ডলাইনে না যাওয়ার কারণে আমাদের এখানে কোয়ারেন্টিন বা লকডাউন মোটেও কার্যকর হচ্ছে না; যা ভয়ের কারণ হয়ে গেছে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কয়েকমাসেই তছনছ করে দিয়েছে সারাবিশ্বকে। গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত করোনায় বিশ্বব্যাপী নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৫২১ জনে। আক্রান্তের সংখ্যা ২১ লাখ ৮২ হাজার ১৯৭ জন। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মহামারী করোনাভাইরাস। এতে ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের। করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ২৬৬ জন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল এক হাজার ৮৩৮ জন।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে কার্যত পুরো দেশই এখন লকডাউন। কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যেই রাস্তায় চলছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের তাÐব, বাজারের উপচেপড়া ভিড়, পাড়া মহল্লায় চায়ের দোকানে আড্ডাসহ মানুষের ঘর থেকে বের হওয়ার প্রবনতা অব্যাহত রয়েছে। মহাসড়কগুলোতে ব্যারিকেড দেয়ার পরেও বিভিন্ন অজুহাতে শহরে ঢুকছে মানুষ। আবার অনেকে বেরিয়েও যাচ্ছে। শিক্ষিত ভদ্ররা করোনার সংক্রমণের ভয়ে নিয়ম মেনে ঘরবন্দি থাকলেও এক শ্রেণির মানুষকে কোনোভাবেই মানানো যাচ্ছে না। গলধঘর্ম হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষজ্ঞদের মতে, কমপক্ষে ৭০ শতাংশ লকডাউন কার্যকর করা না গেলে সেই লকডাউন কোনো কাজে আসবে না। তার মানে কোটি কোটি মানুষের ঘরবন্দি থাকার ফলাফল কিছু মানুষের কারণে অকার্যকর হতে চলেছে। এ নিয়ে দেশব্যাপী মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই।

সারাদেশকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা দেয়ায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ব্যবস্থা কঠোরভাবে নেয়ার সুযোগ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্লেষকরা বলেন, দেশ এরইমধ্যে মহামারীর পর্যায়ে চলে গেছে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মপরিকল্পনা কঠোরভাবে অনুসরণের পাশাপাশি সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামছে গার্মেন্টস শ্রমিকরা। গত দু’দিন ধরে ঢাকার বাড্ডা, মিরপুর, পল্লবী, কমলাপুর, উত্তরাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে গার্মেন্টস শ্রমিকদের একই তাÐব দেখা গেছে। হাজার হাজার গার্মেন্টস কর্মীর জমায়েতের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নীরব থাকতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, এর আগে চলতি মাসের ৪ তারিখে নদীপথে ফেরিযোগে ও সড়কপথে পায়ে হেঁটে গাজীপুর, সাভার ও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের দিকে আসে হাজার হাজার শ্রমিক। সে সময়ও শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পরে আবশ্য আইজিপির নির্দেশে মহাসড়কে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে গার্মেন্টস শ্রমিকরা চলে আসে কর্মক্ষেত্রে। এর ২/৩দিন পর বেশ কিছু গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করা হলে আবার তারা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ইতোমধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে কর্মস্থলফেরত গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যেই। নারায়ণগঞ্জে করোনা সংক্রমণের নেপথ্যেও ওইসব গার্মেন্টস শ্রমিকরাই। এদের কারণে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ডাক্তাররাও আতঙ্কিত। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার আব্দুল আলীম এ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, সামাজিক বা শারিরক দূরত্ব না মেনে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিক্ষোভ-অবরোধের নামে যা করছে তা আমাদের সবার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এদের দ্বারা হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হতে পারে। তখন সেই সব মানুষকে চিকিৎসা দিতে হবে আমাদের মতো ডাক্তারকেই। সহকর্মী ডাক্তার মঈনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মঈন রোগী দেখতে গিয়েই করোনার আক্রান্ত হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের তাÐবের কারণে না জানি আরও কতো মঈনের প্রাণ ঝরে যায়।

করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বার বার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। রাস্তায় রাতদিন কষ্ট করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পথে পথে ব্যারিকেড দিয়ে যান ও মানুষ চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে গোটা রাজধানীজুড়েই। অথচ রাজধানীর পাইকারি ও কাঁচাবাজারগুলোতে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। সাত সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ভিড় লেগেই আছে। ঠেলাঠেলি করে কেনাকাটা করছে মানুষ। এতে করে শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসে দেশে প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও এ যেন ইচ্ছেকৃত সংক্রমিত হওয়ার মিলনমেলা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের বেশিরভাগই নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীন। বাজারে কাজ করা একজন শ্রমিক জানান, যদি আল্লাহ তায়ালা আমার ক্ষতি দেন, তাহলে এমনিতেই হবে। আরেক মহিলা ক্রেতা বলেন, চেষ্টা করছি দূরত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা করার। কিন্তু আসলে সম্ভব হচ্ছে না। বাজারে মানুষ অনেক বেশি। বাজার মনিটরিংয়ে দায়িত্ব থাকা একজন জানান, বাজারের ভেতরে যারা মাস্ক পরছেন না। তাদেরকে মাস্ক পরার বিষয়ে বলা হচ্ছে। নিরাপদ দূরত্বে থাকার বিষয়ে বলা হচ্ছে। কিন্তু আসলে কেউ মানছেন, অনেকেই মানছেন না। বাজারের পাইকারী মাছ বিক্রেতা গোলাম ফারুক বলেন, ভোর থেকেই ঠেলাঠেলি করে মানুষ বাজারে হাঁটাহাঁটি করলেও প্রশাসনের কাউকে দেখিনি। শুধু কাওরান বাজার নয়, মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট, নিউমার্কেট কাঁচাবাজার, যাত্রাবাড়ী আড়ত, কাপ্তানবাজার, মহাখালী বাজারের চিত্রও একই।

বাজার বিশ্লেষক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, মনিটরিং জোরদার করা ছাড়া এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। তিনি বলেন, কাওরান বাজারে ট্রাকগুলো যে পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে, সেখানে ট্রাকগুলো যদি কন্ট্রোল করা যায় এবং কমে কমে ছাড়া যায়। একই সঙ্গে যে ক্রেতারা কিনতে আসবে তাদেরকে যদি কন্ট্রোল করে ছাড়তে পারেন, ভেতরেও যদি লোক সমাগম কম হয়। এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর যদি ভিতরে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারে তাহলেই রক্ষা পাবেন। জানা গেছে, এরইমধ্যে দুইজন ব্যবসায়ী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় কাওরান বাজারের একাংশ লকডাউন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে, দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের কথা জানা যায় গত ৮ মার্চ। শুরুর দিকে সংক্রমণের হার কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও পরিস্থিতি দ্রæতই বদলাতে থাকে চলতি মাসের শুরুর দিক থেকে। আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে শনাক্তের হার। আক্রান্ত হওয়া শুরু হয় একের পর এক জেলায়।

গত ৯ এপ্রিল দেশে মোট শনাক্ত ছিল ৩৩০। সপ্তাহ ঘুরে পরের বৃহস্পতিবার সে সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৭২। বিভিন্ন এলাকায় দ্রæত ছড়িয়ে পড়ায় চিত্রও ভয়াবহতারই ইঙ্গিত দেয়। ৯ এপ্রিলের ২২ জেলা থেকে সপ্তাহ ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে এই সংক্রমণ ব্যাধির বিস্তার এখন ৪৪ জেলায়।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন সংক্রামক রোগ আইনের ক্ষমতাবলে গত বৃহস্পতিবার সারাদেশকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট ও সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এপিডেমিকের ওপর একটা আইন আছে। সরকার সেই আইনটা এখন হয়তো প্রয়োগ শুরু করতে পারে। অর্থাৎ কেউ যদি নিয়ম না মানে তাহলে তাকে পানিশমেন্ট দেয়া। অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, যে হারে রোগী বাড়ছে তাতে আজ থেকেই আমরা ধরে নিতে পারি যে, আমরা মহামারীর মধ্যে ঢুকে গেছি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ান উর রহমান বলেন, ভয়াবহ মহামারীতে আমরা উপরের দিকে উঠছি। আস্তে আস্তে উঠতে থাকব। কতদূর পর্যন্ত উঠব সেটা এখন বলা যাচ্ছে না। সেটা সময় বলবে। তিনি বলেন, আমরা যদি লকডাউন খুব কঠোরভাবে প্রয়োগ করে সমাজের সবাইকে আইসোলেট করে ফেলতে পারি তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা ছোট হবে। নাহলে এই সংখ্যা বড় হবে। অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানউর রহমান বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত যে সকল কর্মপরিকল্পনা আছে, সেই নীতিমালা সম্পূর্ণ অনুসরণ করে আমাদের এটা করতে হবে। সেটা না মেনে এই এপিডেমিক থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে করোনা যুদ্ধ জয়ের একমাত্র অস্ত্র হলো ঘরে থাকা। এবং এই সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীকে যথাযথ কর্তৃত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকই রাস্তায় আছে কিন্ত আমার মনে হয় নানাবিধ কারণে তারা হার্ডলাইনে যেতে পারছে না। হার্ডলাইনে না যাওয়ার কারণে আমাদের এখানে কোয়ারেন্টিন বা লকডাউন মোটেও কার্যকর হচ্ছে না।

https://www.dailyinqilab.com/article/284322