১৮ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ৫:৩৮

রাজধানীর লকডাউন অবস্থা: জরিমানায়ও কমছে না জনসমাগম

র‌্যাব-পুলিশের নিয়মিত অভিযানেও কমছে না মানুষের অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি। করোনার বিস্তার রোধে মানুষের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পরও গত কয়েকদিনে অন্তত ৪ শতাধিক ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছে। বাজারগুলো তো নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা।

রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, দেশে করোনার বিস্তার চলছে জ্যামিতিক হারে। রাজধানীর অলিগলিতেও মানুষের জটলা দেখা যাচ্ছে।

পেটের তাগিদে রাইড শেয়ারিংয়ের চালক ও দু-একটি সিএনজি অটোরিকশাকে দেখা গেলেও অনেকেই অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। এ অবস্থায় মানুষকে লকডাউন মানতে বিকল্প চিন্তা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বলতে গেলে রাজধানী এখন সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। বাস-ট্রেন-নৌ যোগাযোগ বন্ধ। অকারণে ঘোরাঘুরি ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করেছেন।

বৃহস্পতিবারও রমনা থানা এলাকায় ৯ জনকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং শাহবাগ থানায় তিনজনকে ৬০০ টাকা জরিমানা করা হয়। ওয়ারী থানা এলাকার ২ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

র‌্যাবের ডিজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, লকডাউন এবং মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে আমাদের কার্যক্রম চলছে। মাইকিং করছি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি ওভার প্যাট্রোলিং চলছে। লকডাউন না মানলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। মানুষকে বোঝানো হচ্ছে। এছাড়া ত্রাণসামগ্রী যাতে মানুষের হাতে পৌঁছে সে বিষয়ে র‌্যাব তৎপর রয়েছে।

অমানবিক আচরণ করে মানুষদের বিপদগ্রস্ত করছি না। তবে প্রয়োজনে র‌্যাব কঠোর অবস্থানে যাবে।

র‌্যাবের সহকারী পরিচালক সুজয় সরকার জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৫৭ জনকে ৪ লাখ ২শ’ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরপরও লোক সমাগম ঠেকানো যাচ্ছে না। নিজের সুরক্ষায় মানুষকেই বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। গলির আড্ডাই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। দুপুর ২টার পর গলির সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে পুলিশের কি করার আছে বলুন? পুলিশকে ফাঁকি দিলেও তাদের করোনাকে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই।

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান জানান, লকডাউন পরিস্থিতিতে ডিএমপির পক্ষ থেকে দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছে। মঙ্গলবার রমনা বিভাগের ৮ জনকে ২ হাজার ৫শ’ টাকা, শাহবাগ থানায় একজনকে ৫শ’, কলাবাগান থানায় এক দোকান মালিককে ১ হাজার ৮শ’, ধানমণ্ডি থানা এলাকায় ৪ জনকে ৩ হাজার ২শ’ টাকা জরিমানা করে ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত।

রামপুরা থানা এলাকার ৭ জনকে ১ হাজার ৬৫০ টাকা এবং মুগদায় এক সিএনজিচালককে ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়। ওয়ারী থানা এলাকার ৫ জনকে ১ হাজার ৬শ’ ও যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার ৪ জনকে ৫ হাজার ৫শ’ টাকা, চকবাজার থানার ৫ জনকে ২ হাজার ৫শ’ এবং বংশাল থানা এলাকার ২ জনকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা, বিমানবন্দর থানা এলাকার ১৫টি প্রাইভেট কার/সিএনজি/মোটরসাইকেলচালককে ৯ হাজার ৫শ’ টাকা জরিমানা করা হয়।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, বিপুলসংখ্যক মানুষ আইন অমান্য করছেন। সবাইকে জেলে দেয়া সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জরিমানা করা হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে মানুষজনকে সচেতন করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে জরিমানায়ও মানুষকে থামানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আইন ও জরিমানা করে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন সহজ বিষয় নয়। আইন অমান্যকারীদের মধ্যে খেটে খাওয়া লোক যেমন আছে, তেমনি চাকরিজীবী-শিক্ষিত মানুষও আছে। কেউ জরুরি কাজে বের হলেও অনেকে আবার অযথাই বের হয়েছেন।

গত কয়েকদিন সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রধান সড়কে চলাচল সীমিত থাকলেও অলিগলির চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাধারণ মানুষের চা খাওয়া চলছে ও খোলা রয়েছে ছোট ছোট দোকানও। আছে অল্প বয়সীদের সিগারেট হাতে আড্ডাবাজিও।

এছাড়া শুক্রবার সকালের দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ছিল মানুষের ব্যাপক লোক সমাগম। দূরত্ববিধির বালাই ছিল না। মানুষকে গায়ে গায়ে ঘেঁষে তরিতরকারি ক্রয় করতে দেখা যায়।

কথা হয় রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, মানুষের পেটের ক্ষুধা করোনার চেয়ে ভয়ংকর। যতক্ষণ পর্যন্ত দিনমজুরের পেটে খাবার দিতে না পারবেন ততদিন পর্যন্ত মানুষ রাস্তায় বের হবেই। লকডাউন মানাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শুক্রবারও রমনা থানা এলাকায় বেশকিছু সিএনজির বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। বেশকিছু রিকশা-ভ্যান উল্টে রেখে মৃদু শাস্তি দেয়া হয়েছে।

একই ধরনের তথ্য জানিয়ে রামপুরা থানার ওসি আবদুল কুদ্দুস যুগান্তরকে বলেন, রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে দিনভর রিকশা-ভ্যান ও সিএনজির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। এসব যানবাহন আটক রেখে সতর্ক করে চালকদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পরে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রাজধানীর মিরপুর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের নিয়মিত মাইকিং করে বাসা থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে। পুলিশ চলে যাওয়া মাত্রই উঠতি বয়সীরা আড্ডায় মেতে উঠছে। তারা রীতিমতো পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। এতে সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।

বাবু নামে রাইড শেয়ারিংয়ের চালক বলেন, ২৪ মার্চ থেকে রাইড শেয়ারিংয়ের অ্যাপস বন্ধ। এটাই হচ্ছে আমার উপার্জনের একমাত্র পথ। গত ২ দিন সামান্য চিঁড়া-মুড়ি খেয়ে জীবন পার করেছি। কয়েকজন বন্ধু সহযোগিতা করলেও তা শেষ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাইক নিয়ে রাস্তায় নেমেছি।

একই কথা জানালেন মিঠুন ঢালি নামের এক সিএনজি চালক। তিনি জানান, ত্রাণের জন্য সবুজবাগে কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর এলাকার ভোটার কিনা জানতে চাওয়া হয়। ভোটার না হওয়ার কারণে আমাকে কোনো সহযোগিতা করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/299175/