১৩ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৪:৫২

কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে করোনা

দ: এশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের হুঁশিয়ারি; যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যে দুর্যোগ ঘোষণা; ২২ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত; জীবাণু-সন্ত্রাস নিয়ে চিন্তা জাতিসঙ্ঘের

নভেল করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব পড়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, উৎপাদন ও ভোগ, ভ্রমণসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও দামে। ব্যাংক খাতে কমেছে লেনদেন এবং আমানত ও ঋণের অর্থ আদায়। রেমিট্যান্সে অশনি সঙ্কেত। কাজ ও ভিসা হারিয়ে চরম বিপাকে পড়া প্রবাসীদের প্রতিটি রাত কাটছে বিনিদ্র। রফতানিমুখী বিভিন্ন খাতের পণ্য উৎপাদন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ঝুঁকিতে রয়েছেন অনানুষ্ঠানিক ও সেবা খাতের কর্মীরা। চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে জীবন পার করছেন বহু শ্রমজীবী মানুষ। চাহিদা কমে যাওয়ায় কৃষক আর ছোট-বড় খামারিরা অতি সস্তায় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত, অনেকের আয় কমে যাচ্ছে, কর্মহীন হয়ে পড়ছে, বহু মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। সামাজিকতা বিমুখ হয়ে অনলাইন নির্ভরতাও বাড়ছে। করোনা নিঃশব্দে প্রভাব ফেলছে মনে, বদলে দিচ্ছে মানসিক গঠন, সব অঙ্গনেই সৃষ্টি করেছে স্থবিরতা। পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়ে একই সাথে বাড়ছে প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনা। এ দিকে বিশ্বে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯ হাজার ৯৩৩ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ লাখ ৯৪ হাজার ৮১৯ জন। খবর বিবিসি, সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স, আলজাজিরা, ব্লুমবার্গ ও ওয়ার্ল্ডওমিটারসের।

করোনা মোকাবেলা নিয়ে কূটনৈতিক উত্তেজনা : করোনায় পযুর্দস্ত অনেক দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বেড়েছে। স্পেনের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তুরস্কের সরকার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে ‘চীনপ্রীতির’ অভিযোগ তুলে অনুদান বন্ধের হুমকি দিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য সামগ্রীর জন্য সহায়তা চেয়েছিল ইতালি। কিন্তু জার্মানি ও ফ্রান্স, উভয় দেশ বরং এ জাতীয় জিনিসপত্র রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইউরোপের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তায় জন্য তহবিল তৈরিতে ইতালির একটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বার্লিন। ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া ও ফিনল্যান্ড। অন্য দিকে স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া ও লুক্সেমবার্গ প্রস্তাবটিতে সমর্থন দিয়েছে। ইতালি ও রাশিয়াসহ অনেক দেশে রোগটি মোকাবেলা করার জন্য নানারকম উপকরণ ও সহায়তা পাঠিয়েছে চীন। ডোনাল্ড ট্রাম্প জার্মানির উদ্ভাবিত একটি কোভিড-১৯ টিকার একমাত্র অধিকার পাওয়ার জন্য জার্মান কর্মকর্তাদেরও চাপে ফেলেছিলেন। ম্যালেরিয়া বিরোধী ওষুধের রফতানি নিষিদ্ধ করার আদেশ
তুলে না নিলে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্য গোপন করেছে চীন। চীনের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ব্রাজিলও। কাতারে আটকে পড়া মিসরীয় নাগরিকদের নিয়ে কাতার ও মিসরের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে। রাশিয়া প্রভাবিত গণমাধ্যম পশ্চিমা দেশগুলোয় কোভিড-১৯ নিয়ে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখে দক্ষিণ এশিয়া : দক্ষিণ এশিয়া গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল রোববার বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এখানে দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা ঝুঁকিতে পড়েছে। এরই মধ্যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট দৃশ্যমান। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও অন্যান্য কয়েকটি ছোট দেশের এ অঞ্চলে জনসংখ্যা ১৮০ কোটি।

যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যে দুর্যোগ ঘোষণা : ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যে দুর্যোগ ঘোষণা করেছে ফেডারেল সরকার। শনিবার করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে ওয়াইওমিং অঙ্গরাজ্যে দুর্যোগ ঘোষণা করার বিষয়টি অনুমোদন করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; এর মাধ্যমে দেশটির প্রতিটি অঙ্গরাজ্য একসাথে ফেডারেল দুর্যোগ ঘোষণার আওতাভুক্ত হয়। করোনার কারণে হোয়াইট হাউজ এই নিয়ে ৫৫টি দুর্যোগ ঘোষণা দিলো। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সব, পাশাপাশি ইউএস ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, নর্দান মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ, ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া, গুয়াম ও পুয়ের্তো রিকোসহ দেশটির সব অঞ্চল ফেডারেল দুর্যোগ ঘোষণার আওতাভুক্ত হলো।

নিউ ইয়র্কে ভেন্টিলেশনে থাকা ৮০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু : যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কেই করোনায় মারা গেছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষ। এবার নিউ ইয়র্কের চিকিৎসকরা বলছেন, নিউ ইয়র্কে হাসপাতালের আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে থাকা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ৮০ শতাংশই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে। এখন তারা ভেন্টিলেটর ছাড়া অন্য উপায় খুঁজছেন চিকিৎসা দেয়ার জন্য। সাধারণত শ্বাসকষ্টজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটর ব্যবহৃত হয়। আশঙ্কাজনক রোগীদের মধ্যে ভেন্টিলেশনে থাকা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মারা যায়।

২২ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত : নভেল করোনাভাইরাসে বিশ্বের ৫২টি দেশ ও অঞ্চলে ২২ হাজার ৭৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে সেটি কমও হতে পারে। কেননা এখনো ডব্লিউএইচওতে সরাসরি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের তথ্য জানানোর কোনো পদ্ধতি নেই। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে এবং কমিউনিটি উভয় জায়গাতেই সংক্রমিত হচ্ছে।

ব্রিটেনে অনাহারে ১৫ লাখ মানুষ : ক্ষুধা সঙ্কট বাড়ছে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ ব্রিটেনে। মজুদ খাদ্য শেষ হয়ে গেছে বহু পরিবারের। পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে সতর্ক করেছে দাতব্য ও স্থানীয় সরকার-প্রশাসন। ‘ফুড ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, গত তিন মাসের লকডাউনকালে প্রায় ১৫ লাখ নাগরিক অনাহার-অর্ধাহারে থাকছে। খাদ্য কেনার মতো টাকাও নেই তাদের হাতে। করোনা প্রতিরোধে তিন মাস ধরে তালাবন্দী ব্রিটেন। ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়েছে ১০ লক্ষাধিক মানুষ।

মহামন্দার চেয়েও খারাপ হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি : কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ১৯৩০ সালের মহামন্দার চেয়েও খারাপ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর বসন্তকালীন সভা উপলক্ষে দেয়া এক বার্তায় তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে বহু দেশের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। উদীয়মান দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহামন্দার পর সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বিশ্ব অর্থনীতি। আমরা আশা করেছিলাম ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় প্রবৃদ্ধি হবে। কিন্তু আশঙ্কা করছি ১৭০টি দেশে মাথাপিছু আয় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে।

ফের আক্রান্ত খতিয়ে দেখবে ডব্লিউএইচও : সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে মনে হওয়ার পরও কিছু কোভিড-১৯ রোগীর দেহে ফের ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তের তথ্য পাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিছু কোভিড-১৯ রোগী নভেল করোনাভাইরাস মুক্ত হয়েছেন, পরীক্ষায় এমনটি নিশ্চিত হওয়ার পর যখন তাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে, তখন আবার পরীক্ষায় তাদের দেহে নতুন করে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া এমন কিছু ঘটনার তথ্য পেয়েছে ডব্লিউএইচও। এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলো খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

জীবাণু-সন্ত্রাস নিয়ে চিন্তা জাতিসঙ্ঘের : চীনকে অভিযুক্ত করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেলি ক্র্যাফটের দাবি, ‘কোভিড-১৯-এর উৎস, গঠনগত বৈশিষ্ট্য ও সংক্রমণ নিয়ে সঠিক বিজ্ঞাননির্ভর তথ্য প্রকাশ করা হোক। চীন ইচ্ছাকৃতভাবে করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম করে দেখাচ্ছে।’ উল্টো দিকে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুনের দাবি, ‘করোনা নিয়ে অযথা রাজনীতি বা সংক্রমণ নিয়ে কাউকে দোষারোপ বন্ধ করা হোক।’ এই বাগি¦তণ্ডার মধ্যেই জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস পাল্টাপাল্টি দোষারোপ বন্ধ করে সম্মিলিতভাবে লড়াইয়ের ওপরই জোর দেন।

চীনে নতুন করে আক্রান্ত বাড়ছে : চীনে নতুন করে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। শনিবার দেশটিতে ৯৯ জনের শরীরের এ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। আগের দিনের শুক্রবার এ সংখ্যা ছিল ৪৬। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি মানুষের শরীরে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। শনিবার নতুন করে শনাক্ত ৯৯ জনের মধ্যে ৯৭ জনেরই বিদেশ থেকে আগতদের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

কারফিউর মেয়াদ বাড়াল সৌদি আরব : বিদ্যমান কারফিউর মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ। ঘোষণায় বলা হয়েছে, পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে। করোনা মোকাবেলায় সৌদি আরবে গত ২৩ মার্চ থেকে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ২১ দিনের কারফিউ জারি করা হয়। তবে গত সপ্তাহে রাজধানী রিয়াদ, তাবুক, দাম্মাম, দাহরান, হফুফ, জেদ্দা, তায়েপ, কাতিফ ও খোবারের মতো বড় শহরগুলোকে ২৪ ঘণ্টা কারফিউর আওতায় নিয়ে আসা হয়।

রাশিয়ার হাসপাতালে ঠাঁই নেই : হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে রাশিয়ায় করোনা রোগীর সংখ্যা। বাড়তি রোগীর চাপ সমালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মস্কোর হাসপাতালগুলোকে। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাম্বুলেন্সের সারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় রোগীদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য। এমন চিত্র মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গ দুই জায়গায়ই। প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন রোগীর সংখ্যা।

তুরস্কের ৩১টি প্রদেশে কারফিউ : তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ ৩১টি প্রদেশে করোনার কারণে দুই দিনের কারফিউ জারি করেছে দেশটির সরকার। কারফিউ ঘোষণা করা হয় তা কার্যকর হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে। শনিবার ৩১ প্রদেশে কারফিউ জারি করা হলে ইস্তাম্বুলের ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের নিজেদের বাজার মজুদ করার জন্য ভিড় করতে শুরু করেন গোটা শহরে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/495394/