৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:০২

এলোমেলো ৫ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাসূচি

এক দশক ধরে পূর্বনির্ধারিত শিক্ষাসূচি অনুযায়ীই চলছে শিক্ষাব্যবস্থা। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয় পাবলিক পরীক্ষা। যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশ শেষে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছরে যথাযথভাবে সিলেবাস শেষ করেই নেওয়া হয় বিভিন্ন শ্রেণির পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাসূচি এলোমেলো হয়ে গেছে।

প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি ও ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এবারও ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে এই পরীক্ষাসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগে হরতাল-অবরোধেও একাধিকবার পরীক্ষা

স্থগিত হয়েছে। কিন্তু স্থগিতের দিনই পরিবর্তিত তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসে গতিবিধি বোঝা না যাওয়ায় পরীক্ষার নতুন কোনো তারিখ ঘোষণা করতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থী।

করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রথম দফায় গত ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আবার দ্বিতীয় দফায় ৯ এপ্রিল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সময়সীমা বাড়ানো হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্ষপঞ্জি অনুসারে রমজান, ঈদুল ফিতরসহ বেশকিছু ছুটি মিলিয়ে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ছুটি রয়েছে। এ ছাড়া এপ্রিল মাসে শবেবরাত, স্টার সানডে ও পহেলা বৈশাখের ছুটি রয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটি বাদে ৪ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১৪ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। তাই করোনাভাইরাস রোধে এই ১৪ দিনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে চায় উভয় মন্ত্রণালয়। করোনাভাইরাসের পরিস্থিতির উন্নয়ন হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ঈদুল ফিতরের আগে আর খুলছে না বলে জানা যায়। এতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিশুরা যাতে বাড়িতে পড়ালেখা অব্যাহত রাখে সে ব্যাপারে নিজ নিজ স্কুলের শিক্ষকদের খোঁজখবর রাখতে বলেছি। এ ছাড়া আমরাও টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছি। আর পরীক্ষার ব্যাপারে স্কুল খোলার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

জানা যায়, মার্চ মাসের শেষের দিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সিটি পরীক্ষার সূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। আর জুন-জুলাইয়ে ষান্মাষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় এপ্রিলের শুরুতেই প্রথম সাময়িক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সিটি এবং প্রথম সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। অনেক স্কুল থেকেই শিক্ষার্থীদের এসএমএস বা ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, বাসায় ষান্মাষিক পরীক্ষার পড়া শেষ করতে। ঈদের পর স্কুল খুললেই পরীক্ষা।

একাধিক শিক্ষার্থী-অভিভাবক বলছেন, সিলেবাস অনুযায়ী স্কুলে পড়ানো হয়। এরপর প্রত্যেক শিক্ষার্থীই একাধিক প্রাইভেট-কোচিংয়ের দ্বারস্থ হয়। তার পরও ঠিকমতো প্রস্তুতি হয় না। অথচ এবার স্কুল বন্ধ, প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ। তার পরও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আর স্কুল খোলার পর কোনো রকমে তাড়াহুড়ো করে সিলেবাস শেষ করা হলেও শিক্ষার্থীরা তা আত্মস্থ করতে পারবে না।

তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর গত রবিবার থেকে সংসদ টেলিভিশনে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস সম্প্রচার শুরু করেছে, যা কিছুটা হলেও উপকারে আসবে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। তবে যেসব শিক্ষার্থী ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করছে তাদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। দু-চারটি স্কুল তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পড়ালেখার ব্যাপারে নির্দেশনা দিলেও বেশির ভাগই নিশ্চুপ রয়েছে।

মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘শিক্ষাসূচি কিছুটা এলেমেলো হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা যেন অব্যাহত থাকে সে জন্য টিভিতে ক্লাস প্রচারসহ নানা উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

জানা যায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এসএসসির তত্ত্বীয় এবং ৫ মার্চ ব্যাবহারিক পরীক্ষা শেষ হয়। সেই হিসাবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের কথা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নোত্তরের অপটিকাল মার্ক রিডার (ওএমআর) শিট দেখা স্থগিত করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এ ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকায় লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখার কী অবস্থা তা জানতে পারছে না বোর্ডগুলো। ফলে যথাসময়ে ফল প্রকাশ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধান পরীকক্ষরা খাতা নিয়ে বোর্ডে আসতে পারছেন না। যদি আগামী সপ্তাহে অফিস ও গণপরিবহন খুলে যায়, তাহলে আমরা যথাসময়েই এসএসসির ফল দিতে পারব। আর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অন্তত ১৫ দিন পর থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু করতে হবে।’

করোনার প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ রয়েছে পরীক্ষাও। এমনকি বছরজুড়েই থাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পরীক্ষা। কিন্তু করোনার কারণে সব পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোয় সামার সেমিস্টারের ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। জুলাই মাসে এইচএসসির ফল প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। নভেম্বরে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু এবার যথাসময়ে ভর্তি প্রক্রিয়া ও ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে না। ফলে সব মিলিয়ে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীও সংকটে রয়েছেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/03/31/892821