২৭ মার্চ ২০২০, শুক্রবার, ৩:৫৮

সারা দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ঢাকার রাজপথ মানবশূন্য

করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সারাদেশে বাস চলাচল বন্ধ হয়েছে। লঞ্চ, রেল ও বিমান চলাচল আগে থেকেই বন্ধ। ফেরিতে করে যান ও সাধারণ যাত্রী পারাপার চলছে সীমিত পরিসরে। রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব জেলায় রাস্তায় লোক চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ফলে রাজপথ যেন পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে।

গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর টার্মিনালগুলো থেকে কোনও পরিবহন ছেড়ে যায়নি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও কোনও পরিবহন ছেড়ে আসছে না। একসঙ্গে দুই জন চলাচলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর এ কারণেই ঢাকা এখন একেবারেই ফাঁকা। গতকাল সকাল থেকে সারা দেশের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত ২৪ মার্চ সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক ভিডিও বার্তায় আজ ২৬ মার্চ থেকে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেন। সরকারের এমন ঘোষণার পর গতকাল সকাল থেকে কোনও ধরনের পরিবহন চলাচল করছে না। নগরীর সড়কগুলোও জনমানবশূণ্য অবস্থায় রয়েছে। সকালে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ফুলবাড়িয়া, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে কোনও বাস ছেড়ে যায়নি। এসব টার্মিনালের শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। যারা ঢাকায় রয়েছেন তারা টার্মিনালগুলোতে রান্না করে খাচ্ছেন।

সায়েদাবাদ আন্তজেলা বাস-মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানান, সকাল থেকে একটি বাসও ছাড়া হচ্ছে না। রাস্তাঘাটে কোনও লোকজন নেই। এমন পরিবেশ আর কখনও হয়নি। আমাদের টার্মিনালের শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছে। এখন আমি তাদের রান্না করার ব্যবস্থা করছি। গরিব এই শ্রমিকদের পাশে যেন সবাই এগিয়ে আসে সেজন্য আমি সরকার ও বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

একই অবস্থা গাবতলী টার্মিনালেও। জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের পরিচালক মারুফ তালুকদার সোহেল জানান, আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একটি পরিবহনও চলছে না। যাত্রীও নেই। একই চিত্র দেখা গেছে ফুলবাড়িয়া, মহাখালীসহ রাজধানীর অন্যান্য পরিবহন টার্মিনালগুলোতে।

নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) থেকে দেশের সব রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই সদরঘাট থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। টার্মিনালেও জনশূন্যতা বিরাজ করছে। আমরা কোনও লঞ্চ চলতে দিচ্ছি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকরাও অনেক সচেতন রয়েছে।

গত ২৪ মার্চ থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য যাত্রীবাহী রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর ফলে সকাল থেকে কমলাপুর স্টেশন থেকে কোনও ট্রেন ছাড়া হয়নি। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, গত মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ রয়েছে।

এদিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে বিমান যোগাযোগও প্রায় বন্ধ রয়েছে। তবে চীন ও লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ স্বাভাবিক আছে।

রাজধানীর মোড়ে মোড়ে পুলিশের কঠোর পাহারা: করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সারাদেশে ‘অঘোষিত’ লকডাউনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। লোকজনের ভিড় ঠেকাতে রাজধানীর মোড়ে মোড়েও পুলিশ সদস্যরা কঠোরভাবে পাহারা দিচ্ছেন, তল্লাশি করছেন সন্দেহভাজনদের ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রাজধানীর দয়াগঞ্জ মোড়, যাত্রাবাড়ি, ধোলাই পাড়, জুরাইন, মতিঝিল, শাহবাগ, নীলক্ষেত, কারওয়ান বাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এসব চিত্র দেখা যায়।

পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ মোড়। চৌরাস্তার চারদিকে পুলিশ ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। সহজে কোনো গাড়ি ব্যারিকেড পার হয়ে যেতে পারছে না। রিকশা চলাচলের জন্য রাস্তা রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ছাড় পাচ্ছেন না।

দেখা যায়, একজন মোটরসাইকেল আরোহী এলে তাকে আটকে দেয় পুলিশ। পুলিশ জানতে চায়, তিনি কোথায় বের হয়েছেন? লোকটি জানালেন, এমনি বের হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের এক সদস্য তাকে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিলেন। লোকটিও সরি বলে ফিরে চলে গেলেন।

আরেকজন বয়স্ক লোক বাজার নিয়ে আসছিলেন কিন্তু মুখে মাস্ক নেই। এজন্য তাকেও আটকে দেয় পুলিশ। সেখানে থাকা গেন্ডারিয়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রশিদ বলেন, কাউকে ছাড় নয়। অযথা যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হচ্ছে।

সকাল সাড়ে ১০টা রাজধানীর যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা এলাকা। ব্যাগ-বস্তা নিয়ে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছেন। গন্তব্য তাদের গ্রাম। কিন্তু কোনো গাড়ি নেই। আরিফ নামে তাদের একজন জানালেন, তিনি ২০ বছর ধরে এই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। তবে এরকম অবস্থা কোনো দিন চোখে পড়েনি। মাঝেমধ্যে দু’একটি পিকআপ চলাচল করছে মালামাল পরিবহন করছেন। সেগুলো থামিয়ে লোকজন যাওয়ার চেষ্টা করছেন তবে পুলিশ বাঁধা দিচ্ছে।

সায়েদাবাদ এলাকায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট গোলাম রাব্বানী বলেন, কোনো গাড়ি যেন চলাচল করতে না পারে সেজন্য পাহারা দেওয়া হচ্ছে।

মতিঝিলের আরামবাগ এলাকায় দেখা যায়, কয়েকজন লোককে আটকে পুলিশ জেরা করছেন। তারা কেন বাইরে বের হয়েছেন, কোথায় যাচ্ছেন, মুখে মাস্ক নেই কেন এসব জিজ্ঞেস করছে পুলিশ। এতে অনেকে ‘সরি’ বলে আর বের হবেন না বলে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেককে কঠোর ভাষায় সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।

কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ে দেখা যায়, যাদের মাস্ক পড়া নেই তাদের ধরে মাস্কের দোকানে পাঠানো হচ্ছে। কেউ বাজার করে ফেরার পথে পুলিশের জেরার মুখে পড়ছেন। গাড়ি তো নেই বললেই চলে। যেসব গাড়ি চলছে সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নয়তো গণমাধ্যমের। এছাড়া কোনো গণপরিবহন চলছে না।

রাজধানীর শাহবাগের চিত্রও একই। এই মোড়ে যে কয়েকটি গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে তার সবই অ্যাম্বুলেন্স। রোগী নিয়ে অনেকে এসেছেন। দুই-চারটা রিকশাও চলতে দেখা গেছে এই সড়কে। এখানেও পুলিশের তল্লাশি করতে দেখা গেছে।

তল্লাশির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, যেহেতু সরকার নির্দেশনা দিয়েছেন নগরবাসীকে ঘরে থাকার জন্য, তাই সবাইকে ঘরে রাখতেই পুলিশের এ অবস্থান। সব মিলিয়ে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। একটাই উদ্দেশ্য সবাই ঘরে অবস্থান করুক। জাতীয় এ স্বার্থে সবাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তার জন্যও আহ্বান জানান তিনি।

http://dailysangram.info/post/411383