টিআইবির সংবাদ সম্মেলন : নয়া দিগন্ত
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:৫৬

বছরে সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করছে বিদেশীরা

টিআইবির গবেষণা তথ্য : উত্তরণে ৯ দফা সুপারিশ

বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীরা বছরে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। বেতন-ভাতার নামে এই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘বাংলাদেশে বিদেশীদের কর্মসংস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল বুধবার টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি।

বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে প্রায় আড়াই লাখ। এই হিসাবে দেশ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিটেন্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায় এবং তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে কমপক্ষে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। তবে বাংলাদেশে বিদেশী কর্মী নিয়োগে কোনো সমন্বিত ও কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা এবং বিদেশী কর্মী নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় বিদেশী কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা এবং অবৈধভাবে পাচারকৃত রেমিট্যান্সের পরিমাণ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় বিদেশীদের কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ৯ দফা সুপারিশ প্রদান করে সংস্থাটি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টাÑ নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান এবং সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর-ই-খোদা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। আর এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে গবেষণায় বিদেশীদের কর্মসংস্থানের আইনি কাঠামো পর্যালোচনা, বিদেশীদের কর্মসংস্থানের কারণ, ধরন ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ এবং বিদেশীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ও বেতনভাতা সম্পর্কিত অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৪টিরও বেশি দেশের নাগরিক বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছেÑ ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি বিদেশী কর্মী কাজ করছে তৈরী পোশাক ও টেক্সটাইলসংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশী কর্মরত রয়েছেন।

গবেষণায় দেখা যায়, কর্মরত বিদেশী নাগরিকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশী কর্মীর প্রতি স্থানীয় মালিক পক্ষের অকারণ পক্ষপাত রয়েছে। কারখানা পর্যায়ে কাজ করার ক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে অনীহা থাকার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে খাতভিত্তিক দক্ষ স্থানীয় জনবল তৈরিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের ঘাটতি থাকায় নিয়োগকারীরা বিদেশী কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকেন বলে জানা যায়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিদেশী নাগরিকদের আগমন, অবস্থান ও কর্মসংস্থান নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইন, নীতিমালা ও গাইডলাইন থাকা সত্ত্বেও পর্যটক ভিসা ও ভিসা অন অ্যারাইভাল নিয়ে কর্মানুমতি ছাড়াই বিদেশী নাগরিকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের নথিপত্রে বিদেশী কর্মীর কোনো উল্লেখ থাকে না, তাদের জন্য পৃথক হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। আবার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা আইন (সংশোধিত) ২০১৫ অমান্য করে বেশির ভাগ বিদেশী নাগরিকই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে থাকে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর অঞ্চল ১১তে ৯৫০০ জন বিদেশী কর্মী ১৮১ কোটি টাকা আয়কর প্রদান করেন। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অনুসারে দেশে কর্মরত বিদেশীদের আয়ের ৩০ শতাংশ কর হিসেবে উল্লিখিত অর্থবছরে এই বিদেশী কর্মীদের আয়ের পরিমাণ ৬০৩ কোটি টাকা হিসাবে তাদের গড় বেতন হয় ৫৩ হাজার টাকা বা ৬০০ ডলার। অথচ এই গবেষণা অনুযায়ী বিদেশী কর্মীদের প্রাক্কলিত ন্যূনতম মাসিক গড় আয় ১৫০০ ডলার বা ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে বৈধ প্রক্রিয়ায় কর্মরত বিদেশী কর্মীদের প্রকৃত বেতন গোপন করা হয় এবং অপেক্ষাকৃত কম বেতন প্রদর্শিত হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রকৃত বেতনের এক-তৃতীয়াংশ (প্রায় ৩০%) বৈধভাবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় এবং বেতনের বাকি অংশ অবৈধভাবে নগদ দেয়া হয়ে থাকে। অন্য দিকে অবৈধভাবে কর্মরত কর্মীদের শতভাগ বেতন অবৈধভাবে নগদ অথবা অন্য কোনো দেশের (দুবাই/সিঙ্গাপুর) ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মীর নিয়মিত হাতখরচ, আবাসন, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধা প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে।

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গবেষণায় যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, ‘বিপুলসংখ্যক এই অবৈধ বিদেশী কর্মী মূলত এক ধরনের বহুপক্ষীয় যোগসাজশ, সংশ্লিষ্ট নীতি ও বিধিমালা প্রয়োগের ঘাটতি, নিয়োগকারী ও নিয়োগপ্রাপ্তদের অনৈতিকতা, দায়িত্বশীলদের একাংশের অদক্ষতা ও সমন্বয়ের ঘাটতির ফলেই এই অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ফলে রাষ্ট্র তথা জনগণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাস্তব সুফল ভোগ করতে পারছেন না, আমাদের উন্নয়নের সুফল দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে।’

গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বিদেশীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি ৯ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে।

উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলোÑ বিদেশী কর্মীর নিয়োগে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত কৌশলগত নীতিমালা প্রণয়ন; বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের সব তথ্য কার্যকর উপায়ে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সুবিধার্থে সব আগমন ও প্রত্যাগমন পথে সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু এবং সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ থাকা। এ ক্ষেত্রে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে প্রতি মাসেই ইস্যুকৃত ভিসার শ্রেণী অনুযায়ী বিবরণী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো, বাংলাদেশের ‘পোর্ট অব এন্ট্রি’ যেমনÑ বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে অবস্থিত ইমিগ্রেশন অফিসকে বিদেশীদের আগমন ও নির্গমন তালিকা প্রতি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ, ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ সংখ্যা সমন্বয়ের জন্য দূতাবাস প্রেরিত তালিকা এবং বিমান বা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিস প্রেরিত তালিকা সমন্বয় করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা কর্তৃক আগত সব বিদেশীর একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা; বিদেশী কর্মীদের ভিসা সুপারিশপত্র, নিরাপত্তা ছাড়পত্র, কর্মানুমতি এবং ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত সেবা প্রদানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা;
বিদেশী কর্মীদের ন্যূনতম বেতন সীমা হালনাগাদ করা; বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী মিশনে ভিসা প্রদানে অনিয়ম বন্ধ করাÑ মেশিন রিডেবল ভিসা ব্যতীত অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ভিসা (সিল) প্রদান বন্ধ করা; বিদেশী কর্মীদের তথ্যানুসন্ধানে বিভিন্ন অফিস/কারখানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিডা ও পুলিশের বিশেষ শাখার সমন্বয়ে যৌথ টাস্কফোর্স কর্তৃক অভিযান পরিচালনা; খাতভিত্তিক বিদেশী কর্মীর চাহিদা নিরূপণ, এ ক্ষেত্রে বিদেশী কর্মী নিয়োগের পূর্বশর্তগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করা; শিল্প খাত বিকাশের সুফল গ্রহণে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা; এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পখাতভিত্তিক স্থানীয় মানবসম্পদের দক্ষতা ও যোগ্যতার উন্নয়নে নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।