দরপতনের প্রতিবাদে গতকাল ডিএসই ভবনের সামনে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন : নয়া দিগন্ত
১৫ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ২:০৭

পুঁজিবাজারে সর্বস্বান্ত বিনিয়োগকারী

কোথায় গিয়ে থামবে জানা নেই কারো ; মামলার ভয় উপেক্ষা করে বিক্ষোভ ; জরুরি বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়

ভয়াবহ ধস নেমেছে পুঁজিবাজারে। অব্যাহত দরপতনে দেশের দুই বাজারের সব সূচক নেমে গেছে ভিত্তি পয়েন্টের নিচে। এর পরও পতন থামবে কি না তা জানা নেই কারো। প্রতিদিন বাজার পতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। ফলে হতাশা আর ক্ষোভে মামলার ভয় উপেক্ষা করে গতকাল মঙ্গলবার আবারো রাস্তায় নেমে আসেন তারা। ডিএসইর সামনে বিক্ষোভ থেকে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারের আচরণ স্বাভাবিক নয়। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে তা বলা মুশকিল। বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাই পতনের মূল কারণ। সরকারের নানা আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজার ভালো হবে, হচ্ছেÑ এমন প্রতিশ্রুতি শুনে লাখ লাখ লোক বাজারে বিনিয়োগ করে এখন প্রায় সর্বস্বান্ত। তার ওপর ব্যাংক খাতে চলছে দুরবস্থা। এতে তারল্য সঙ্কটে পড়েছে বাজার। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতা, বাজারে সুশাসনের অভাব, ডিএসইর এমডি নিয়োগে জটিলতা ইত্যাদি বিষয়গুলোও পুঁজিবাজারকে গভীর খাদে নামানোর জন্য দায়ী।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সোমবার লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স সূচকটি ৮৯ পয়েন্ট কমে নেমে আসে ৫৬ মাস আগের অবস্থানে। তবে সূচক প্রায় পাঁচ বছরের কম হলেও অধিকাংশ শেয়ারের দাম ৯ বছর আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। সোমবার লেনদেন শেষে সূচকটির অবস্থান হয় চার হাজার ১২৩ পয়েন্ট। গতকাল আবারো ৮৭ পয়েন্ট কমল সূচকটির। এতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া ৪০৫৫ ভিত্তি পয়েন্টের নিচে নেমে এলো সূচক। এ ছাড়া গত এক বছরের ব্যবধানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ কোটি টাকা। গত বছরের ১৪ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল চার লাখ ১৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। আর গতকাল দিন শেষে তা নেমে এসেছে তিন লাখ ১৩ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে যে বড় দরপতন হচ্ছে এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বিনিয়োগকারীরা হুজুগে শেয়ার বিক্রি করছেন। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন অনেক নিচে নেমে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাজারের ওপর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন যে তারা আর কোনো ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে বোর্ডসভায় যে ঘটনা ঘটেছে তা পত্রিকা মারফত আমরা জানতে পেরেছি। এগুলোও বিনিয়োগকরীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে যে, যারা কারসাজি করে, যারা মার্কেট নষ্ট করে বোল্ড হবেন তারা খুব তৎপর। এরা নিজেদের লোকজন নিয়ে আসতে চাচ্ছে ডিএসইর ম্যানেজমেন্টে। এটা বিনিয়োগকারীদের জন্য অশনি সঙ্কেত বলেন এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার আরো অনেকগুলো কারণ আছে। যেমন-আমাদের মানি মার্কেটে তারল্য সঙ্কট, সুদের হার বেশি, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট, সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। এর সাথে এখন যোগ হয়েছে সুশাসনের সঙ্কট। কেন যেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই প্রতিযোগিতা করে দুঃশাসন নিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আমরা অর্থমন্ত্রীর সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছি। গ্রামীণফোনসহ জটিল বিষয়গুলো আমরা বৈঠকে তুলে ধরেছি। এসব বৈঠক সুফল বয়ে আনেনি। বাজারের মূল সমস্যাগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারলেও তার সমাধান হয়নি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। গ্রামীণফোনের সমস্যার সমাধান হয়নি। এতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের যে দরপতন হয়েছে, তাতে আমাদের কিছু করার ছিল না। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা ছাড়া বাজারের এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কষ্টকর।

এ দিকে মামলার ভয় দূরে ঠেলে শেয়ারবাজারের ভয়াবহ দরপতনের প্রতিবাদে আবারো মতিঝিলে অবস্থিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) আগের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন বিনিয়োগকারীরা। গতকাল দুপুরে ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদে’র ব্যানারে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ থেকে বরাবরের মতো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়।

এর আগে দরপতনের প্রতিবাদে দিনের পর দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করায় গত ২৭ আগস্ট ডিএসইর পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছিল, ২৭ আগস্ট আনুমানিক বেলা ২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশ পুঁজিবাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ৯-১০ জন লোক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের সামনে ব্যানার ও মাইকসহ বিক্ষোভ মিছিল করে। ফলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াত এবং অফিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্পাদনে বিঘœ ঘটে। এতে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বেশ কিছু দিন ধরে তারা এ ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছে এবং পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সম্মানহানিকর মন্তব্য করছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মনে করে এ ধরনের কার্যকলাপ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং বহির্বিশ্বে পুঁজিবাজারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করছে। ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলেও সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়।

ডিএসইর পক্ষ থেকে এই সাধারণ ডায়েরি করা হলে বন্ধ হয়ে যায় বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ। তবে শেয়ারবাজারে চলতে থাকে দরপতন। দরপতনের ধারা সম্প্রতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করলে গতকাল আবার রাস্তায় নামেন তারা। এ সময় বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বিএসইসির এই চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে শেয়ারবাজার ভালো করা যাবে না। আমরা বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। সেই সাথে পুরো কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

অর্থমন্ত্রীর বৈঠক : পুঁজিবাজারের অস্থিরতার মধ্যে এ নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী ২০ জানুয়ারি দুপুরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব ড. নাহিদ হোসেনের সই করা এক চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পুঁজিবাজার উন্নয়নে অর্থমন্ত্রীর সাথে অংশীজনের মতবিনিময় সভার প্রস্তাবনার যথাযথ বাস্তবায়ন কাজ সমন্বয় ও তদারকির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের গঠিত কমিটি এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে আলোচনার জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হবে। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নূরের সভাপতিত্বে বেলা ২টায় আইসিবি পরিচালনা পর্ষদ কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো: মাসুদ বিশ্বাস, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মো: সাইফুর রহমান, আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/472315/