২ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১:১৩

মন্ত্রণালয়ের বিশেষ তদন্ত

বুকিং ফাঁদে বিমান

রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ বিমানে টিকিট পাওয়া সহজলভ্য নয়। বুকিং দিতে বা নগদে কিনতে গিয়ে অনেক সময়ই শুনবেন, সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। দেশের ভেতরে বা আন্তর্জাতিক রুট- সব ক্ষেত্রেই এ অবস্থা। কিন্তু প্রায়ই দেখবেন, বিমান কিছু খালি আসন নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ, ট্রাভেল এজেন্টদের বুকিং ফাঁদ। ট্রাভেল এজেন্টদের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অপ্রয়োজনীয় বুকিংয়ের ফলে কাগজে-কলমে কোনো আসন খালি থাকে না বিমানে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র এর বিপরীত। শেষ পর্যন্ত অনেক টিকিট বিক্রি হয় না। বিক্রি না হলেও শুধু এই বুকিংয়ের জন্য গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম বা জিডিএস কোম্পানিগুলোকে কমিশন দিতে হয় বিমানকে।

সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক বিশেষ তদন্তে বিমানকে বুকিং ফাঁদে ফেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আতিকুল হকের নেতৃত্বে এ তদন্তে উঠে এসেছে, ট্রাভেল এজেন্টদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র কৌশলে আয় করতে এবং যাত্রীদের কাছে অজনপ্রিয় করতে বাংলাদেশ বিমানকে বুকিং ফাঁদে ফেলেছে। এ তৎপরতায় ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে বুকিং কোম্পানি, বিভিন্ন বেসরকারি এয়ারলাইন্স, এমনকি বিমানের কর্মীরাও জড়িত বলে মনে করছে তদন্ত দল।

জানা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানে ২২টি ট্রাভেল এজেন্টের বুকিংয়ের ওপর তদন্ত করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আটটি ট্রাভেল এজেন্ট এ সময়ে ৪৫ হাজার ৯৪৪টি টিকিট বুকিং করে ৩৮ হাজার ৯৫২টি টিকিট বাতিল করেছে, যা তাদের বুকিংয়ের ৮৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এসব বুকিং বাতিল হলেও বিমান থেকে ঠিকই কমিশন বাবদ ১৫ হাজার ৬১৫ মার্কিন ডলার নিয়েছে জিডিএস কোম্পানিগুলো। তদন্তের পর ওই আট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। এসব এজেন্ট পাঁচ বছর ধরে এভাবে টিকিট বুকিং ও বাতিল করে আসছিল। তদন্তে তারা তা স্বীকারও করেছে। এ জন্য বাংলাদেশ ট্রাভেল এজেন্সি (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিভিন্ন সময়ে যে লোকসান দিয়েছে, তার অন্যতম কারণ এই বুকিং ফাঁদ।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আতিকুল হক সমকালকে বলেন, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার যাত্রীদের অভিযোগ ছিল, বিমানের টিকিট কিনতে গেলে পাওয়া যায় না, আবার চড়লে দেখা যায় আসন খালি যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তদন্তে দেখা গেছে, জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে কিছু ট্রাভেল এজেন্ট দীর্ঘদিন ধরে বুকিং দিয়ে টিকিট বিক্রি বন্ধ রাখছে। শেষ সময়ে এসে বুকিং বাতিল করে দিচ্ছে। এতে বুকিং বাবদ জিডিএস কোম্পানি ঠিকই তাদের পাওনা নিয়ে নিচ্ছে বিমান থেকে, যার একটি অংশ চলে যাচ্ছে ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে। অন্যদিকে বিমান ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অন্যান্য এয়ারলাইন্স সহজে অনেক যাত্রী পাচ্ছে। তিনি বলেন, জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চুক্তিতে ত্রুটির কারণে এ সুযোগ নিয়েছে তারা। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলেও কেউ চুক্তির ত্রুটি শোধরানোর উদ্যোগ নেয়নি। এই তদন্তের পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনা করে সংশোধন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম বা জিডিএস হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিমানের টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা। বাংলাদেশে অ্যাবাকাস, গ্যালিলিও ও সাবরি নামে তিনটি জিডিএস কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এয়ারলাইন্সগুলোর চুক্তি থাকে। টিকিট বিক্রি ও বুকিংয়ে জিডিএস কোম্পানিকে কমিশন দিতে হয় এয়ারলাইন্সগুলোকে। বুকিং হলেই প্রতি টিকিটের বিপরীতে পাঁচ থেকে আট ডলার পেয়ে থাকে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশ বিমান যে চুক্তি জিডিএস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে করেছে, সেখানে শুধু টিকিট বুকিং ও বিক্রির কমিশনের কথা উল্লেখ রয়েছে। জিডিএসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ কতভাগ বুকিং বাতিল করতে পারবে বা কত সময় আগে পর্যন্ত করতে পারবে কিংবা এ বাবদ বিমানের ক্ষতিপূরণের কী হবে- এসব বিষয় চুক্তিতে স্পষ্ট নেই। বাংলাদেশ বিমানের বেশিরভাগ টিকিট বিক্রি হয় হয় 'সাবরি' নামে জিডিএস কোম্পানির মাধ্যমে। এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন সমকালকে বলেন, জিডিএস

কোম্পানিগুলোর সঙ্গে করা চুক্তি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে চুক্তি অনেক পুরোনো। চুক্তি পর্যালোচনা করতে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করার কাজ রয়েছে। এ জন্য সময় লাগবে। অভিযোগের বিষয়ে সাবরির বাংলাদেশ কান্ট্রি ম্যানেজার মোহাম্মাদ সাইফুল হক সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে, তা সঠিক নয়। জিডিএস কোম্পানি বিশ্বব্যাপী এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রির পদ্ধতিগত সহায়তা করে মাত্র। এ জন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এয়ারলাইন্সের চুক্তি থাকে। কিন্তু ট্রাভেল এজেন্ট কীভাবে কোন পদ্ধতিতে টিকিট বুকিং করছে, তার সঙ্গে জিডিএস কোম্পানির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সব ট্রাভেল এজেন্টের জন্যই একই ব্যবস্থা। কারও জন্য আলাদা কিছু নেই। বাংলাদেশ বিমানের বুকিং সংক্রান্ত কোনো সমস্যা থাকলে সংস্থাটি অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর পাশাপাশি এজেন্টদের সঙ্গে কর্মপরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে পারে।

জানা গেছে, অপ্রয়োজনীয় বুকিং দিয়ে তার সিংহভাগ বাতিলের অভিযোগে ফেনীর বিপ্লব ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এজেন্ট, চট্টগ্রামের কোতোয়ালির ঊর্মি ট্রাভেল এজেন্সি, পাঁচলাইশের দারুল ইমান ইন্টারন্যাশনাল এবং পূর্ব ষোলশহরের চৌধুরী ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার মাদারল্যান্ড ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল, সামস এয়ার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল, মুনা ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস এবং ট্রাভেল সেন্টারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি বুকিং বাতিল করেছে চট্টগ্রামের ঊর্মি ট্রাভেল এজেন্সি। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৮৩৬টি টিকিট বুকিং দিয়ে ২৯ হাজার ৮৮৫টি বুকিং বাতিল করেছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মাহবুবুল আলমের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, বুকিং করে পরে বাতিল করা হচ্ছে, সে বিষয়ে কেউ তাকে অবহিত করেনি। অফিসের কর্মকর্তারা তাকে না জানিয়ে এসব করেছে। এ জন্য তিনি সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।

ফেনীর বিপ্লব ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা অসীম কুমার ফোন ধরেন। তাকে বিস্তারিত জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী এটিএম এনামুল হকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অসীম কুমার বলেন, 'স্যারকে বিস্তারিত জানিয়ে আপনাকে ফোন করা হবে।' এর পর তিনি আর ফোন করেননি এবং পুনরায় তাকে ফোন করলে ধরেননি।

চট্টগ্রামের আরেক প্রতিষ্ঠান দারুল ইমান ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরসের অফিসে ফোন করে কথা বলার লোক পাওয়া যায়নি। একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বুকিং বাতিলের অভিযোগ ছিল ২২ ট্রাভেল এজেন্টের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির এজেন্ট রয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে আট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বাকিদের ক্ষেত্রে রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

মতামত জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম সমকালকে বলেন, অনেক আগে থেকেই বিমান এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। এয়ারলাইন্স ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্তরা বিষয়টি সব সময়ই অবহিত। তাদেরই উচিত ছিল, আগে থেকে সচেতন হওয়া এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া। এখন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে শুধু ট্রাভেল এজেন্টকে দায়বদ্ধ করলেই এর শেষ হবে না। বিমানের যারা এ কাজে সম্পৃক্ত তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

বিমান চলাচল খাতের সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এয়ারলাইন্সের বুকিং বিভিন্ন কারণে বাতিল হতে পারে। যাত্রীর অসুস্থতা, বিদেশে সভা-সেমিনারসহ যাত্রীর ভ্রমণ উপলক্ষীয় অনুষ্ঠানের তারিখ পরিবর্তন, অন্য জরুরি কাজে আটকে পড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে বুকিং বাতিল হয়ে থাকে। এ জন্য বিমান পরিসেবার আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে বুকিং বাতিলের গ্রহণযোগ্য সীমা আরোপ করেছে। তা হচ্ছে এজেন্ট সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ বুকিং বাতিল করতে পারবে। এর চেয়ে বেশি বাতিল হলে তা সন্দেহজনক ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে মনে করা হয়।

https://samakal.com/bangladesh/article/19112939