গুঁড়া হলুদে ব্যবহৃত বিষাক্ত সিসা মানবশরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সিসা মিশ্রিত হলুদ দীর্ঘদিন ধরে খাওয়া হলে হৃদরোগ, প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিভ্রম, মাথাব্যথা, বিষণ্ণতা, হরমোনজনিত রোগ ও ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে। এতে রক্তের স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত এবং শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
খাদ্যে ব্যবহৃত হলুদে মারাত্মক বিষাক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। হলুদের রঙ উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় করতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিসা মিশিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিডিডিআর’বি পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায় এমন সব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রীত হলুদের গুঁড়ার রঙ উজ্জ্বল করতে মারাত্মক বিষাক্ত সিসা (লেড ক্রোমেট) ব্যবহার করা হচ্ছে। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে এ ধরনের হলুদের ক্ষতিকর সিসা অস্থিমজ্জায় ক্রিয়া করে রক্তের স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে। শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এমনকি মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। তাই বাজারে বিক্রীত গুঁড়া হলুদের পরিবর্তে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে হলুদ গুঁড়া করে ব্যবহারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ অনুযায়ী- হলুদ প্রক্রিয়াজাতকরণে কোনো ধরনের উজ্জ্বল রঙ বা সংযোজন থেকে সব ধরনের মসলা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে হলুদে এসব রঙ বা লেড ক্রোমেট মেশানো হচ্ছে। যা বাজারে পিউরি, পিপড়ি, বাসন্তী রঙ, কাঁঠালি রঙ নামে পরিচিত। এ রঙ মূলত ছবি আঁকা বা আলপনা আঁকার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, উজ্জ্বল রঙ নয়- এমন হলুদ আকর্ষণীয় করতে বিক্রেতারা হলুদে লেড ক্রোমেট ব্যবহার করে। বিশেষ করে যেসব ব্যবসায়ী হলুদ গুঁড়ো করে বাজারজাত করে, তারা এটি ব্যবহার করে। এতে হলুদের রঙ উজ্জ্বল হয় এবং ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়।
বাজারে খোলা বা প্যাকেটজাত হলুদের গুঁড়ার মধ্যে উচ্চ মাত্রার লেড ক্রোমেটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষকরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০০টিরও বেশি নমুনায় (হলুদ, হলুদের অবশিষ্ট এবং ব্যবহৃত স্থানের মাটি) এর উপস্থিতি পেয়েছে। এর পরিমাণ প্রতি গ্রামে ১,১৫২ মাইক্রোগ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ৪,২৫৭ মাইক্রোগ্রাম। এর সঙ্গে জড়িত দেড় শতাধিক ব্যবসায়ী হলুদে রঞ্জক হিসেবে সিসা মেশানোর কথা গবেষকদের কাছে স্বীকার করেছে। নতুন এ গবেষণায় হলুদে সিসার যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, তা অন্যসব অনুরূপ গবেষণায়প্রাপ্ত ফলাফলের চেয়ে দুই থেকে ১০ গুণ বেশি।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়- বাংলাদেশের মানুষ রান্না করা তরকারির রঙ উজ্জ্বল করতে প্রধানত হলুদ ব্যবহার করে। তাই এ দেশের মানুষের কাছে হলুদের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। হলুদে ক্ষতিকর রঙ মেশানোর প্রধান কারণও এটি। স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করে গবেষক দল বলেছে, ক্রেতারা হলুদে বিষাক্ত রঙ ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে পারলে তা আর ব্যবহার করবে না। বাজার থেকে গোটা হলুদ কিনে নিজেরাই গুঁড়ো করে বা পিষে সেগুলো ব্যবহার করবেন।
এ প্রসেঙ্গ আইসিডিডিআর’বির এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারভেনশন ইউনিটের গবেষক ডা. মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যেসব মিলে হলুদ গুঁড়া করা হয়, সেই মিলগুলোর মাটির নমুনাতেও প্রতি গ্রাম মাটিতে সর্বাধিক ৪,২৫৭ ক্রোমেট সিসার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
তিনি বলেন, মিলে হলুদ গুঁড়া করার আগে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের হলুদ ড্রামে বা বড় পাত্রে লেড ক্রোমেট গোলানো পানিতে ভিজিয়ে রাখে। এতে হলুদের রংয়ের অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য আসে। তারা (অসাধু ব্যবসায়ীরা) শুধু ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার করে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ের হলুদ গুঁড়া বিক্রেতা এবং প্যাকেটজাত হলুদ গুঁড়া বিক্রেতারা এগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে।
তিনি বলেন, এ ধরনের হলুদ ব্যবহারে শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবকি বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এছাড়া হৃদরোগসহ নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করে। বাজারের এসব হলুদগুঁড়া পরিহার করে হলুদ কিনে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ভাঙিয়ে নিতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান।
গবেষণায় বলা হয়- হলুদের পাইকারি বিক্রেতাদের তথ্যে জানা গেছে, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তারা হলুদে লেড ক্রোমেট ব্যবহার করে আসছে। ঢাকার প্রধান প্রধান পাইকারি বাজারে সিসা মিশ্রিত এসব গোটা হলুদ বিক্রি হতে দেখা গেছে। স্থানীয় প্রশাসন বাজারগুলো পর্যবেক্ষণ করলে সিসা মিশ্রিত এসব ক্ষতিকর হলুদ বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক প্রফেসর স্টিফেন পি লবি উল্লেখ করেন, প্রতি গ্রাম হলুদে সিসার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জে পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, রক্তে সিসার কোনো সহনীয় মাত্রা নেই। যদিও রক্তে সিসার প্রচলিত মাত্রা হল (ইউএসএ) পাঁচ মাইক্রোগ্রাম। তবে বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মাত্রা দুই দশমিক পাঁচ মাইক্রোগ্রাম।
তিনি বলেন, সিসার কারণে পরিপাকতন্ত্রের রোগ যেমন কোষ্টকাঠিন্য, বমিভাব, ক্ষুধামন্দা, অরুচি হতে পারে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিভ্রম, মাথাব্যথা, বিষণ্ণতা ও হরমোনজনিত রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো ভারি ধাতু মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। সিসা একটি মারাত্মক ভারি ধাতু। মানুষ খাবারের মাধ্যমে বা যে কোনোভাবে সিসা গ্রহণ করলে, সেটি রক্তে মিশে অস্থিমজ্জায় প্রভাব বিস্তার করে। একপর্যায়ে শরীরে স্বাভাবিক রক্ত উৎপাদন, বিশেষ করে লোহিতকণিকা উৎপাদন ব্যাহত করে। এতে মানুষের মধ্যে শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ অবস্থাকে বলা হয় হেমোক্রোমটেসিস। যা একপর্যায়ে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।