১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১২:৪২

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সুপারিশ

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা

পাসপোর্ট নবায়ন হবে না * রেজিস্ট্রেশন নয় নতুন কেনা জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়ির

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আসছে। তাদের পাসপোর্টও নবায়ন করা হবে না। এসব ব্যক্তির নতুন কেনা জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়িও রেজিস্ট্রেশন করা হবে না।

এমন বিধান রেখেই সংশ্লিষ্ট আইন সংস্কারের সুপারিশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এর আগে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কারা তা শনাক্তে সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে বলা হয়।

এছাড়া কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি অক্ষম হলে অর্থঋণ আদালত আইনে তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করার বিধানও যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

এছাড়া ব্যাংকের দাবি আদায় সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য দু’জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।

এতে বিচারকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ আয়োজন করার কথাও বলা হয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ধরনের ২০ দফা সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশে বন্ধকি সম্পত্তির যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করা ও নিলামে সম্পদ ক্রয়ের জন্য আলাদা অ্যাসেট অ্যাকুইজিশন কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। কোনো রিট পিটিশন এক আদালতে খারিজ হলে অন্য আদালতে দায়ের করা বেআইনি।

যদিও রিট খারিজের তথ্য গোপন রেখে অন্য বেঞ্চে রিট দায়ের করা হচ্ছে। এসব বেআইনি রিটের সঙ্গে জড়িত আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বার কাউন্সিলে লিখিত অভিযোগ করার সুপারিশও এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা যে রিট করেন, তা আরও ব্যয়বহুল করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এদের কীভাবে দমন করেছে, সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এখানে অনেক দফা সুপারিশ করা হয়েছে কিন্তু আসল দফা বাদ পড়েছে।

মূল কথা হল- বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন ছাড়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ধরা সম্ভব হবে না। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের একটি বিশেষ গুণ হল- এখানে কেউ আপিল করতে পারবে না। খেলাপিকে ধরা হবে। তার সব সম্পত্তি ক্রোক এবং দ্রুত সময়ে বিচার সম্পন্ন হবে।

এরা ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছে তার বেশির ভাগ মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে। সে কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকা আদায় করতে পারবে না। যদি টাকা আদায়ের সদিচ্ছা থাকে তবে হার্ডলাইনের বিকল্প নেই।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যেসব প্রস্তাব এসেছে তা বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এটা বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারবে না। করলে সরকারকেই করতে হবে। সরকারের কি সে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে?

সেটাই হল দেখার বিষয়। এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সফল হয়েছে। আমরাও সফল হতে পারতাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এটাকে যথেষ্ট মনে করব না।

তবে আগে এগুলো বাস্তবায়ন করা হোক। এরপরও টাকা না দিলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের জেলে পাঠাতে হবে।

সুপারিশে বাংলাদেশ ব্যাংক অভ্যন্তরীণ ঋণপত্রের বেনিফিশিয়ারি ব্যাংকের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে সার্কুলার জারির কথা বলা হয়। ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের কর্পোরেট গ্যারান্টি বা ব্যক্তিগত গ্যারান্টি গ্রহণের ক্ষেত্রে কোম্পানি বা ব্যক্তির নামে যেসব সম্পদ আছে, তা সংযুক্ত করতে পারে।

এজন্য ব্যক্তি বা কোম্পানির নামে সম্পত্তির তালিকা গ্রহণ এবং তার ওপর রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের চার্জ ক্রিয়েশন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

যথাযথ আইনি প্রতিকার নিশ্চিত করতে ঋণ অনুমোদনপত্র, গ্যারান্টি ও চার্জ ডকুমেন্টগুলো বাংলা ভাষায় প্রস্তুত করতে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি করবে।

সুপারিশে আরও বলা হয়, ব্যাংকগুলো গ্রাহক নির্বাচন, ঋণপত্র স্থাপন, বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়ন ইত্যাদি বিষয়ে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। প্রয়োজনে বিভিন্ন ধাপে সশরীরে উপস্থিত থেকে ব্যাংকাররা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের যথার্থতা নিশ্চিত করতে পারে।

এক্ষেত্রে কেওয়াইসি সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধানগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিপালন করে তবে সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ এর সংশোধনের প্রস্তাবও এসেছে সুপারিশে। এতে বলা হয়, অর্থঋণ আদালতে মামলা চলাকালে যে কোনো সময় বন্ধককৃত সম্পদ নিলামের আদেশ দিতে পারবে। সে ব্যবস্থা রেখে অর্থঋণ আদালত আইনও সংশোধন করা যেতে পারে।

অর্থঋণ আদালত প্রদত্ত রায়-ডিক্রি কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনের ২৮(৪) ধারা অনুযায়ী আলাদাভাবে মামলা দায়ের না করে একই আদালত কর্তৃক স্বয়ংক্রিয়ভাবে জারি হয়ে যাওয়ার বিধান সংযুক্ত করা প্রয়োজন। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এ বিষয়ে আইন কমিশনে প্রস্তাব পাঠাতে পারে।

খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলার ক্ষেত্রে মূল ঋণ ও সুদের অনুপাত সর্বোচ্চ ১:২ রাখার বিধান সংশোধন করতে ব্যাংকগুলো আইন কমিশনে প্রস্তাব দিতে পারে।

বিদ্যমান আইনের ৪৭ ধারা অনুযায়ী অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ব্যাংকের দাবি আসলের চেয়ে দ্বিগুণ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংক, আইন কমিশন, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার (বিয়াক) ও বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিদের দীর্ঘ আলোচনায় দেশের ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান সংকট ও আইনি প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো ওঠে আসে।

তার ভিত্তিতেই কুড়ি দফা সুপারিশ তৈরি করা হয়। গভর্নর ফজলে কবির স্বাক্ষরিত সুপারিশগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/215724/