১৬ জুন ২০১৯, রবিবার, ১:০০

হাসপাতাল অপারেশন খরচ ডাক্তারের ফি পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ এবং সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট

অবগুণ্ঠন উন্মোচন ॥ আসিফ আরসালান : আমাদের দেশে প্রতি বছরের জুন মাসে বাজেট দেয়া হয়। এটাই রেওয়াজ হিসাবে চলে আসছে। অবশ্য অনেক দেশ আছে যেখানে জুন নয়, মার্চ মাসে বাজেট দেয়া হয়। আমাদের দেশে এটাও প্রথা হিসাবে চলে আসছে যে, সংসদে বাজেট পড়া শেষ হয়নি। তার আগেই সরকারি দল মিছিল বের করে বাজেটকে অভিনন্দন জানায়। যেটিকে আমরা বাজেট ডকুমেন্ট বলি সেটি একটি বিশাল ব্যাপার। প্রথমে থাকে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা। তারপর বাজেটের খুটিনাটি বিশ্লেষণ করে একটি বড় বই। তারপর অর্থনৈতিক সমীক্ষা। এমনি অনেক ডকুমন্টে। এগুলো পড়তেই দু’চারদিন লেগে যায়। তারপর পড়ে সেগুলো বোঝার জন্য মার্কার দিয়ে দাগাতে হয়। সকলেই আবার বাজেট বোঝে না। আপনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনা করছেন, তখন সেখানে একটি সাবজেক্ট থাকে। সাবজেক্টটির নাম ‘মানিটারি এবং ফিসক্যাল পলিসি’। বাজেট এই ফিসক্যাল পলিসির আন্ডারে পড়ে। অন্তত আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম তখন অনার্সের পর আমাদেরকে মানিটারি এবং ফিসক্যাল পলিসি পড়তে হতো। সেগুলোতো অনেক দিন আগের কথা। অনেক কিছুই ভুলে গেছি। তবুও ভাসা ভাসা একটি জ্ঞান তো থেকেই যায়। সেই জন্য অর্থনীতি তথা বাজেটের পরিভাষাগুলো অন্তত বুঝতে পারি।

ইকোনোমিকসের একটি ব্যাকগ্রাউন্ড আমার রয়েছে বলেই অন্তত দেড় যুগ অন্য একটি দৈনিক পত্রিকায় আমি বাজেটের ওপর প্রতিবছর একাধিক ভাষ্য ও বিশ্লেষণ লিখেছি। সংগ্রামেও অতীতে কয়েকটি ভাষ্য ও বিশ্লেষণ লিখেছি। আজ ৪০ বছর পর যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন দেখি যে এগুলো লিখে কোনো লাভ হয় না। প্রথম কথা হলো পাঠকদের মধ্যে অনেকেই অর্থনীতি ও আর্থিক বিষয়ের জটিলতা বোঝেন না। আর সরকারও পেপার কাটিংগুলো বিশ্লেষণ করে যদি কোনো যুক্তিপূর্ণ পয়েন্ট থাকে তাহলে সেগুলো যে গ্রহণ করবেন সেরকম মানসিকতা তাদের নাই। তাই আমি অন্য একটি দৈনিক পত্রিকায় বাজেটের ওপর লেখা ছেড়েই দিয়েছি। সংগ্রামেও আজ এই বিষয়টি নিয়ে লিখতাম না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে শুধু বাজেট নয়, দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে মানুষের দুরাবস্থা নিয়ে এই বাজেট উপলক্ষে দুটো কথা বলতে হচ্ছে।

আমি অতীতে বহুবার বলেছি, আজও আবার বলছি যে, বাজেট এককথায় সরকারের বার্ষিক আয় ব্যয়ের ক্ষতিয়ান। বিশেষ করে সরকার কোন খাতে কি খরচ করবে, জনগণের নিকট থেকে তার একটি অনুমোদন দরকার। তত্বগতভাবে পার্লামেন্ট হলো জনগণের মতামতের প্রতিষ্ঠান (যদিও বর্তমান পার্লামেন্ট অনির্বাচিত, অবৈধ এবং জনমতের প্রতিফলন ঘটায় না)। যাই হোক, তবুও গায়ের জোরে সরকার এটিকে পার্লামেন্ট হিসাবে চালাচ্ছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি যে, কোথায় সরকার কত টাকা খরচ করবে, কোন সূত্র থেকে সেসব টাকা আসবে, তার একটি বিস্তারিত হিসাব হলো এই বার্ষিক বাজেট।

সকলেই জানেন যে, এক অর্থে বাজেট হলো দুটো, অর্থাৎ বাজেট দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হলো, উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি। আর একটি হলো রাজস্ব বাজেট। রাজস্ব বাজেট উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে আকারে বড় হয়। কারণ এখানে খরচের খাতটি খুব বড়। বাজেটের টাকা জোগাড় করার অনেকগুলো সূত্র আছে। তার মধ্যে ট্যাক্স বা কর আদায় অন্যতম প্রধান সূত্র। আমরা কথায় কথায় বলি যে ‘কথা বলতে মুখে তো কোনো ট্যাক্স লাগে না’। কিন্তু সরকার এবার কথা বলার ওপরও ট্যাক্স বসিয়েছে। আপনি সেল ফোন বা মোবাইল ফোনে যদি ১০০ টাকার কথা বলেন তাহলে সরকার সেখানে ২৭ টাকা কেটে নেবে। অর্থাৎ আপনি আসলে ৭৩ টাকার কথা বললেন। সেজন্যই বলেছি যে, বাজেটের ওপর লিখে কি লাভ? কথা বলতে গেলেও যদি ট্যাক্স লাগে তাহলে আর মন খুলে কথা বলবেন কিভাবে?

॥দুই॥
এই বাজেটের আয়তন সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকা। সব টাকা সরকারের হাতে নাই। ঘাটতি দেড় লাখ কোটি টাকা। সেই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষ মাথা ঘামান না। বাজেটের আয়তন ৩ লাখ কোটি টাকা হলো না ৫ লাখ কোটি টাকা হলো সেটি নিয়ে জনগণের মাথা ব্যথা নাই। তবে বাজেটে কোন কোন পণ্যের ওপর ট্যাক্স বসলো, অর্থাৎ কোন কোন পণ্যের দাম বাড়বে আর কোন কোন পণ্যের দাম কমবে সেই নিউজটি মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়েন। কিন্তু তাতে লাভ কি কিছু হয় ? ব্যবসায়ীরা মন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় যখন শোনে যে অমুক অমুক পণ্যের ওপর দাম বাড়বে তখন তারা সেটি শুনেই ৪/৫ ঘন্টার ভেতর সেই সেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। অথচ, মন্ত্রী যখন সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন তখন সেটি কিন্তু ফাইনাল বাজেট নয়। সেটিকে বলা হয় প্রস্তাবিত বাজেট। তারপর ২০/২৫ দিন ধরে সেই বাজেটের ওপর সরকার এবং বিরোধীদলীয় নেতারা আলাপ আলোচনা করেন, সংসদের বাইরে বিভিন্ন থিংক ট্যাংক, পত্রপত্রিকায় অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের মতামত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এসব মতামতের কিছু কিছু প্রস্তাবিত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়, আর কিছু কিছু হয় না। বিভিন্ন পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত করে বাজেটে কাটছাট অথবা কিছুটা হ্রাস-বৃদ্ধি করে জুন মাসের শেষ তারিখে বাজেট পাস হয়। সেটিই ফাইনাল বাজেট এবং পরদিন অর্থাৎ ১লা জুলাই থেকে যে নতুন অর্থবছর শুরু হয় সেদিন থেকে ঐ বাজেটটি কার্যকর হয়।

এমনও তো হতে পারে যে প্রস্তাবিত বাজেটে কয়েকটি পণ্যের ওপর ট্যাক্স আরোপিত হলো। ফলে ধরে নেওয়া হলো যে, ঐ পণ্যগুলোর দাম বাড়বে। কিন্তু পরবর্তীতে বাজেট আলোচনার পর কয়েকটি পণ্যের ওপর আরোপিত ট্যাক্স প্রত্যাহার করা হলো। তাহলে সেগুলোর দাম তো আর বাড়ার কথা নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ব্যবসায়ী এবং দোকানদাররা তো বাজেট বক্তৃতা শুনেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। একবার কোনো জিনিসের দাম বাড়লে সেটি কমার কোনো নজির বাংলারদেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে নেই।

এখানে আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যবসায়ী এবং দোকানদাররা কি জিনিসপত্রের দাম বাড়াবার বেলায় বাজেটের জন্য বসে থাকেন? বাংলাদেশে তো সারা বছরই জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। যে কোনো একটা ছুতোনাতা পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। বাজেট নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না, তার ধারও ধারে না। যে দেশে গ্যাসের দাম বাড়লে রিকশা ভাড়া বেড়ে যায় সেদেশে আপনি বাজেট দিয়ে কি করবেন? গ্যাসের দাম বাড়লে না হয় সিএনজি বা বাস গাড়ির ভাড়া বাড়তে পারে। কিন্তু রিকশার সাথে গ্যাসের কি সম্পর্ক? কিন্তু আমাদের দেশের রিকশাওয়ালারা গ্যাসের সাথে রিকশা চালানোর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়েন।

॥তিন॥
আজ আমি স্বাস্থ্য খাতের ওপর বিশেষ করে দুটো কথা বলতে চাই। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি অসুখ বিসুখ হলে মেডিসিনের দুই প্রফেসরকে দেখাই। বছর তিনেক আগের কথা বলছি। তখন একজনের কনসালটেশন ফি ছিল ৬০০ টাকা, আরেক জনের ছিল ৮০০ টাকা। গত বছর একজন তার ফি বাড়ালেন ১০০০ হাজার টাকা, আরেক জন ১২০০ টাকা। এখন চলতি বছরের শুরু থেকে দুজনই তাদের কনসালটেশন ফি বাড়িয়েছেন দেড় হাজার টাকায়। অথচ মাত্র কয়েকদিন আগে দেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ ডাক্তারদের সন্মেলনে তাদের কনসালটেশন ফি কমানোর জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় আপনাদেরকে ডাক্তার বানানো হয়। পাবলিক মেডিকেল কলেজসমূহে আপনারা যে টিউশন ফি বা পরীক্ষা ফি দেন সেই টাকা দিয়ে ডাক্তার বানানোর খরচ এক তৃতীয়াংশও পূরণ হয় না। সেখানে সরকারকে সাবসিডি বা ভর্তুকি দিয়ে ডাক্তার বানাতে হয়। সরকার এই ভর্তুকি দেয় মানুষের সেবা করার জন্য। ডাক্তার হয়ে আপনারা মানুষের সেবা করবেন, সেজন্যই সরকার আপনাদেরকে সাবসিডি দেয়। কিন্তু আপনারা রোগীর নিকট থেকে যে ফি আদায় করেন সেটি সাধারণ মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয় না। তাই সাধারণ মানুষ তাদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেন না।

কিন্তু প্রেসিডেন্টের এসব কথা অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়েছে। তার কথায় কোনো ডাক্তার তার কনসালটেশন ফি তো কমান নি, বরং আমি একজন ডাক্তারের কথা জানি তিনি তার ফি বাড়িয়েছেন দেড় হাজার টাকা থেকে দুই হাজার টাকায়। এখানে কি বাজেটের কোনো ভূমিকা রয়েছে? সরকারের কোনো ভূমিকা রয়েছে?
আর হাসপাতালে ভর্তি ? সাধারণ মানুষের কাছে সেটা তো রীতিমতো সোনার হরিণ পাওয়া। আপনি একটি সাধারণ অপারেশন, অর্থাৎ হার্নিয়া অপারেশন বা পিত্ত থলির পাথর সরানোর অপারেশন করুন। বিল আসবে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। কয়জন মানুষ এই বিশাল অংক এ্যাফোর্ড করতে পারে? একজন জুনিয়র অফিসারও তো মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন পান না। তাহলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হবেন কিভাবে? আপনি যদি একজন ভালো ডাক্তারের কাছে যান তাহলে তাকে কম করে ভিজিট দিতে হবে ১২০০ টাকা। এরপর তিনি আপনাকে ৪/৫টি পরীক্ষা করতে দেবেন। রক্ত, মলমূত্র, এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইটিটি, এন্ডোস্কপি ইত্যাদি হরেক রকমের পরীক্ষা। এসব পরীক্ষা করে আপনি যখন রিপোর্ট নিয়ে যাবেন তখন আবার ফি গুণতে হবে। এসব পরীক্ষা করতে আপনার অন্তত ১০ হাজার টাকা।

আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেককে বলতে শুনেছি, ভাই, আমার ঐসব ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। ছোটখাটো ডাক্তারের কাছে যাবো। তিনি যদি ঐসব পরীক্ষা দেন তাহলে সোজা বলবো, আমার ওসব পরীক্ষার দরকার নাই। আমার অসুখ সম্পর্কে আপনার যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে সেই ধারণার ওপর আপনি ওষুধ লিখে দিন। আমি সেগুলোই খাবো। বাঁচলে বাঁচবো, মরলে মরবো। মরলে আপনাকে দোষ দেবো না। হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে।

এই হলো আমাদের কোটি কোটি লোকের অর্থনৈতিক অবস্থা। সেখানে সোয়া ৫ লক্ষ কোটি টাকার বাজেটই বলুন, আর ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিই বলুন, তাতে এসব কোটি কোটি মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত লোকের কি এসে যায়? উন্নয়নের মহাসড়ক, উন্নয়নের রোল মডেল- এসব গালগল্পে তাদের কি লাভ? এর পাশাপাশি রয়েছে আর একটি শ্রেণী যারা পিত্তথলির পাথর সরানোর জন্য সিঙ্গাপুর যান। খরচ করেন ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা। ক্যান্সার হলে সিঙ্গাপুর আমেরিকা যান। খরচ কোটি টাকার ওপরে। সুতরাং বাজেট বলুন আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলুন- সেটি হচ্ছে কাদের জন্য? কোটি কোটি লোক যেখানে উপযুক্ত চিকিৎসা বঞ্চিত, কোটি কোটি লোক যেখানে দ্ইু বেলা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না, তাদের কাছে সোয়া ৫ কোটি টাকার বাজেট অথবা মধ্যম আয়ের দেশ একটি পরিহাস মাত্র।

https://www.dailysangram.com/post/379259