১৬ জুন ২০১৯, রবিবার, ১২:২১

বাজেটে আলোচনার কেন্দ্রে কালো টাকা খেলাপি ঋণ ও মোবাইল কলের ট্যাক্স

# দেশে কালো টাকা ৭ লাখ কোটি
# খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা
# মোবাইল কোম্পানির কাছে সরকারের পাওনা ১৫ হাজার কোটি টাকা
# দেশ থেকে প্রতিবছর ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে

সরদার আবদুর রহমান : জাতীয় সংসদে সদ্য উপস্থাপিত এবারের বাজেটে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে কালো টাকা সাদা করা, খেলাপি ঋণ মওকুফ ও মোবাইল কলের ওপর বাড়তি ট্যাক্স আরোপ করা। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে কালো টাকার পরিমাণ ৭ লাখ কোটির বেশি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে টেলিটকসহ চারটি মোবাইল কোম্পানির কাছে সরকারের পাওনার পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, জাতীয় অর্থনীতিতে ‘কালো টাকা’র বিষয়টি খুবই সাধারণ ও গতানুগতিকভাবে দেখা হয়। অথচ এই টাকা মূলত ‘অপরাধ-সংশ্লিষ্ট’ বিভিন্ন খাত থেকেই উদ্ভূত হয়ে থাকে। সংসদে বাজেট পেশের পরদিন শুক্রবার বাজেট পরবর্তী এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, ‘দেশের মধ্যে থাকা কালো টাকা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনতেই বাজেটে তা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে; অন্যথায় টাকাগুলো দেশের বাইরে চলে যেতো।’ সুস্থ চিন্তা ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষেরা মনে করেন, এই ‘কালো টাকা’ সাদা করার মানেই হলো অবৈধ অর্থকে বৈধতা প্রদান। জানা যায়, দেশে বর্তমানে ৭ লাখ কোটির বেশি কালো টাকা আছে। এ ছাড়াও প্রতিবছর দেশ থেকে ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। গত এপ্রিলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সভায় এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘বর্তমানে দেশে ৭ লাখ কোটির বেশি কালো টাকা আছে। যা সরকারের দু’টি অর্থবছরের বাজেটের সমান। অর্থাৎ এ টাকা দিয়ে সরকার দুটি অর্থবছরের বাজেট পরিচালনা করতে পারবে।’ এবারের বাজেটে অন্তত ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা যাতে উদ্ধার করা যায়, সেই প্রণোদনা থাকা উচিত। প্রতিবছর ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। তা রোধেও বাজেটে সুস্পষ্ট উদ্যোগ রাখা দরকার বলে সভায় উল্লেখ করা হয়। এবারের প্রস্তাবিত অর্থ বিল অনুসারে, এ বছর পয়লা জুলাই থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই বিনিয়োগ করা যাবে। অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের পুরো সময়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। এছাড়া, প্লট এবং জমি কিনলেও কালো টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তবে প্রতি বর্গমিটারে এ জন্য নির্দিষ্ট কর দিতে হবে।

খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গ : প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৪ সাল থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে ঋণখেলাপিদের ব্যাপক হারে সুবিধা দেয়া শুরু হয়। বিশেষ ছাড়ে খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিল করা হয়। ওই সময় থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংকগুলো। এর বাইরে অবলোপন করে ২০১৪ সালের পর থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের পরিমাণই ১৩ জুন সংসদে পেশ করা বাজেটের প্রায় এক পঞ্চমাংশ অর্থের সমান। খেলাপি ঋণ মওকুফের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের হলে এযাবত তা আটকে আছে। তবে বাজেট পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে খেলাপি ঋণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে ব্যাংক খাতে সুদের হার অত্যন্ত বেশি, আর সুদ ধরা হয় চক্রবৃদ্ধি হারে। ফলে যখন হিসাব প্রকাশ করা হয় তখন চক্রবৃদ্ধি হারে খেলাপি ঋণের পরিমাণটা অনেক বড় দেখায়। প্রকৃত ঋণটা যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে অত বড় না।’ তবে এবিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ যারা নেন তাঁদেরকে চক্রবৃদ্ধি হারেই সুদ দিতে হয়। চক্রবৃদ্ধি সুদ ধরেই খেলাপি ঋণ হিসাব করা হয়। এটাই ব্যাংকের নিয়ম। সরকার খেলাপিদের ঋণের পরিমাণ সরল সুদে হিসাব করবেন। আর যারা নিয়মিত ঋণ গ্রহীতা তারা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দেবেন- এটা কোনো বিচার হলো না।

মোবাইল কলে ট্যাক্স বৃদ্ধি : এবারের বাজেটে মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরফলে মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো এবং ডেটা ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে। মোবাইল ফোন অপারেটররা বলছেন, এর ফলে বর্তমানে সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১ শতাংশ সারচার্জ, ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য মিলে মোট কর দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এই বিপুল বোঝা চাপবে মূলত সাধারণ গ্রাহকদের ওপরে। অভিযোগ উঠেছে, মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাছে সরকারের বিপুল পরিমাণ পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এই শুল্কের বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপানো হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, টেলিটকসহ চারটি মোবাইল কোম্পানির কাছে সরকারের পাওনা ১৫ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্যে সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এই তথ্য জানান। রাজস্ব বকেয়ার এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে টেলিটক, গ্রামীণ ফোন, রবি ও বাংলা লিংক। এ ছাড়া বকেয়া টাকা পরিশোধ না করায় সিটিসেলের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। মন্ত্রী জানান, অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে চালু ফোন কোম্পানিগুলোর মধ্যে সিটিসেলের কাছে ১২৮ কোটি টাকার রাজস্ব বকেয়া রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামীণ ফোন লিমিটেডের কাছে অডিট আপত্তির পরিমাণ ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং রবি আজিয়াটার কাছে বকেয়া ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আর রাষ্ট্রীয় মোবাইল অপারেটর টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে ৩জি স্পেকট্রাম এ্যাসাইনমেন্ট ফি বাবদ ১ হাজার ৫৮৫ কোটি ১৩ লাখ টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে।

https://www.dailysangram.com/post/379261