৫ এপ্রিল ২০১৯, শুক্রবার, ৭:৩৯

অকেজো ওষুধ অজেয় জীবাণু

একটা সময় ছিল যখন সাধারণ সংক্রমণেও মৃত্যুর ঝুঁকি থাকত। নিউমোনিয়া, গনরিয়ার চিকিৎসা ছিল না। সামান্য কাটাছেঁড়ার চিকিৎসাও হয়ে পড়ত দুরূহ। ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিষ্কার খুলে দিল ব্যাকটেরিয়া বধ করার পথ, আবিষ্কার হতে থাকল একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক (জীবাণুনাশক), চিকিৎসকরা বনে গেলেন ধন্বন্তরি। সেই ব্যাকটেরিয়া ক্রমেই অমরত্ব লাভ করছে, তাদের কাছে হেরে যাচ্ছে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক। চোখ বুজে যেসব অব্যর্থ ওষুধ লিখে নিশ্চিত ফল পাচ্ছিলেন চিকিৎসকরা, সেগুলোর এমন বিশ্বাসঘাতকতায় কপালে ভাঁজ গভীর হচ্ছে তাঁদের।

চিকিৎসকদের আশঙ্কা, সাত-আট দশক আগে অ্যান্টিবায়োটিক হাতে না আসায় যেমন সাধারণ সংক্রমণেও রোগীর মৃত্যু হতো, তেমনি এমন সময় আসছে যখন গাদা গাদা অ্যান্টিবায়োটিক হাতে থাকার পরও রোগী বাঁচানো যাবে না।

মারণ ব্যাকটেরিয়াগুলোর এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট (জীবাণুনাশক প্রতিরোধী) হয়ে যাওয়াকে সারা বিশ্বে এ সময়ের অন্যতম ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গণ্য করছেন চিকিসক ও ওষুধবিজ্ঞানীরা। এ সংকটের মূলে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বা অপপ্রয়োগ, যার ভয়াবহতা থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ২০ লাখ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে মারা যাচ্ছে অন্তত ২৩ হাজার মানুষ। আর আগে অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ করত, এখন প্রতিরোধী, এমন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে সৃষ্ট জটিলতায়ও আরো অনেক মৃত্যু ঘটছে সে দেশে।

বাংলাদেশে এ রকম পরিসংখ্যান নেই। রোগীর দেহে কোনো ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী কি না, তা পরীক্ষা করার সুযোগও ঢাকার বাইরে কয়েকটি বড় শহর ছাড়া আর নেই। এ ধরনের সংক্রমণের ভয়াবহতা বুঝতে হলে যেকোনো হাসপাতালের আইসিইউয়ে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান। তাঁর মতে, আইসিইউয়ে ভর্তি থাকা প্রতি ১০ জন রোগীর সাতজনের দেহেই এমন ব্যাকটেরিয়া মিলবে, যেটি কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই দমন করা যায় না। সর্বশেষ পর্যায়ের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে হয়তো অন্তিমসময়ের প্রহর গোনে চিকিৎসক ও স্বজনরা।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (এনআইএআইডি) পরিচালক অ্যান্টনি ফসির মতে, ব্যাকটেরিয়া স্বাভাবিকভাবেই বদলায়। ওষুধের কারণে তারা আরো বেশি বদলায় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারেই এ সমস্যা প্রকট হয়েছে। যখন দরকার নেই তখনো দেওয়া হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে ব্যাকটেরিয়ার ওপর, অথচ না বুঝে ভাইরাসজনিত রোগেও এটি দেওয়া হচ্ছে। আবার ভুল অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ফলেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ একটি অ্যান্টিবায়োটিকে রোগীর দেহের কিছু ব্যাকটেরিয়া মরবে, অন্যগুলো হয়ে পড়বে অজেয়।

বাংলাদেশের জন্য এসব কারণের সঙ্গে বাড়তি দুটি কারণ যুক্ত করেছেন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান। এগুলো হলো, ওষুধের দোকান থেকে নিজের ইচ্ছামতো যখন-তখন অ্যান্টিবায়োটিক কেনা আর চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ করা ডোজ শেষ না করা। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয় না। আমাদের দেশের আনাচকানাচে প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার ওষুধের দোকান আছে। গড়ে দুটি করে হলেও প্রতিদিন পাঁচ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হচ্ছে। এখন যে আমরা কথা বলছি, এই সময়ের মধ্যেও বিক্রি হয়ে গেছে কয়েক হাজার অ্যান্টিবায়োটিক। এটি দেখার কথা ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের, তাদের সেই সক্ষমতা নেই।’

অ্যান্টিবায়োটিক খেতে শুরু করে একটু ভালো বোধ করলে অনেক রোগী নির্দিষ্ট কোর্স শেষ করে না। ফলে তার দেহে ওই বিশেষ ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এটিও বড় সমস্যা। অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বেশি। তাই সরকারি হাসপাতাল থেকে অসচ্ছল রোগীদের ওষুধ সহায়তা দেওয়া হয়। সেখানেও দেখা যায়, বহির্বিভাগে প্রেসক্রিপশনে সাত দিনের কোর্স লেখা রয়েছে, কাউন্টার থেকে তিন দিনের দেওয়া হলো। অনেক রোগীই এর পরে আর কেনে না, কোর্সও শেষ করে না। ফার্মাকোলজিস্ট অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘এতে শুধু রোগীর একার ক্ষতি হলো তা নয়, তার দেহে যে ব্যাকটেরিয়াটি প্রতিরোধ গড়ে তুলল, সেটি সহজেই তার সংস্পর্শে আসা যে কারো দেহে ঢুকে যেতে পারে, অন্যরাও পড়তে পারে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার ঝুঁকিতে।’

অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের পরামর্শ, অনেক ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ট্যাবলেটের মতো পুরো কোর্সের হিসাবে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ একটি বোতল বা প্যাকেটে রেখে বিক্রি করা যেতে পারে, যাতে খোলা একটা-দুইটা না কেনা যায়। আর সরকারি হাসপাতালে তাদের দৈনিক বরাদ্দ অনুযায়ী যে কয়জনকে সম্ভব যেন পুরো কোর্সের ওষুধই দেওয়া হয়। তাঁর মতে, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কোর্সের আংশিক দেওয়ার চেয়ে না দেওয়া ভালো।

জনসতর্কতার জন্য স্ট্রিপে বা বোতলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের নাম লাল রঙে লেখার পরামর্শ দিয়ে এ ফার্মাকোলজিস্ট বলেন, এ জন্য বাড়তি কোনো টাকা খরচ হবে না কারো। লাল রংটি অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য রেখে তাদের লেবেলে ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে ওষুধ কম্পানিগুলোকে। রং দেখেই সাধারণ মানুষ চিনতে পারবে, সতর্ক হবে। চিকিৎসকরাও প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক লাল রঙে লিখতে পারেন অথবা চিহ্নিত করে দিতে পারেন।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য শুধু ফার্মেসি বা রোগীকে দায়ী করলেই হবে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তথা চিকিৎসকদেরও আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন আছে। কারণ আমাদের অনেকেরই শুরুতেই হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার প্রবণতা আছে। এটিও খুব ক্ষতিকর একটি দিক।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/04/05/755178