৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১২:১৬

কিশোর অপরাধের প্রধান কারণ দারিদ্র্য!

মাধ্যমিকের পাঠ্যবই

অষ্টম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের দশম অধ্যায়ের নাম বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা। এখানে বাংলাদেশের কিশোর অপরাধ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিশোর অপরাধের কারণ বিষয়ে লেখা হয়েছে, ‘শিশু-কিশোররা নানা কারণে অপরাধী হয়ে উঠে। আমাদের দেশে কিশোর অপরাধের অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারের কিশোরদের অনেক সাধ বা ইচ্ছাই অপূর্ণ থেকে যায়। ফলে তাদের মধ্যে বাড়ে হতাশা এবং এ হতাশাই তাদেরকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় ও শিল্পাঞ্চলে বস্তি রয়েছে। বস্তির পরিবেশ ও সেখানকার নানা খারাপ অভিজ্ঞতা শিশু-কিশোরদের অপরাধী করে তোলে। সঙ্গদোষে এবং অপরাধের তাড়নায়ও বস্তির শিশু-কিশোররা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোররা অল্প বয়সেই নানা রকম কাজ করে টাকা উপার্জন করতে বাধ্য হয়। এই টাকায় কখনো কখনো তারা জুয়া খেলে, মদ গাঁজা খায় এবং অশোভন ছবি দেখে। অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে বা লোভে পড়েও তারা অনেক সময় অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে।’

কিশোর অপরাধের কারণ সম্পর্কে আরো লেখা হয়েছে ‘শারীরিক-মানসিক ত্রুটি বা বৈকল্য শিশু মনে হীনমন্যতার জন্ম দেয়। এর ফলেও অনেকে অপরাধী হতে পারে।’

নবম-দশম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ১৬তম অধ্যায়ের নাম বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা ও এর প্রতিকার। এখানে কিশোর অপরাধ বিষয়ে লেখা হয়েছে, সামাজিক সুষ্ঠু পরিবেশ ও মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে খারাপ সঙ্গ এবং পাচারকারী বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত হয়ে শিশু-কিশোররা অপরাধী হয়ে ওঠে। ... বঞ্চিত ও অবহেলিত শিশু-কিশোররা সহজেই অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। ... পারিবারিক অভাব-অনটন, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং বাবা-মায়ের দায়িত্বহীন আচরণ ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে শহরের বস্তিতে বসবাসকারী কিশোররা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।

দারিদ্র্য দেশের কিশোর অপরাধের প্রধান কারণ এ দাবি মানতে পারছেন না অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে চাঞ্চল্যকর যেসব কিশোর অপরাধের ঘটনা ঘটেছে তার সাথে দারিদ্র্য ও দরিদ্র পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই মর্মে দেখা গেছে। বরং এর সবগুলোর সাথে জড়িত সমাজের উচ্চবিত্ত, ক্ষমতাবানদের পরিবারের কিশোররা। যেমন মাদকাসক্ত ও বিপথগামী ঐশী কর্তৃক মা বাবাকে হত্যা, পছন্দের মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় ফরিদপুরে মুগ্ধ কর্তৃক পিতাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, মিরপুরে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার কারণে একাদশ শ্রেণীর তিন বন্ধু মিলে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীকে খুন করা, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা গ্যাং স্টার গ্রুপের খুনাখুনিসহ এ ধরনের অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাথে জড়িত সমাজের বিত্তবানদের সন্তানরা। এ ছাড়া মাদক, সন্ত্রাস, প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল ও যৌন অপরাধ, অপহরণসহ আরো অনেক ঘটনার সাথে জড়িত যাদের নাম দেখা যায় তারা প্রায় সবাই ধনাঢ্যদের সন্তান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এজসান হাবীব নয়া দিগন্তকে বলেন, কিশোর অপরাধের বিষয়ে যা লেখা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে তা বর্তমান সময়ের সাথে খাপ খায় না। বর্তমানে কিশোর অপরাধের যে ধরন, প্রযুক্তির ব্যবহার ও সচ্ছল পরিবারের কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারণ আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার ছিল। দরিদ্র্যতা কিশোর অপরাধের একটি কারণ কিন্তু তা বর্তমানে অন্যতম প্রধান কারণ নয়। বর্তমানে আমাদের উপজেলা এবং গ্রামাঞ্চলেও মানুষের অনেক অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল পরিবারের কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। সঙ্ঘবদ্ধভাবে অনেক অপরাধও তারা করছে এখন। এর সাথে দারিদ্র্যের তেমন সম্পর্ক নেই বরং সম্পর্ক রয়েছে সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা, সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়া নৈরাজ্য আর মূল্যবোধের পতনসহ আরো অনেক কিছুর।

অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক অভিযোগ করলেন, লেখাটিতে দারিদ্র্যকে যেভাবে কিশোর অপরাধের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তাতে সমাজের দরিদ্র পরিবারের প্রতি এক ধরনের বর্ণবাদী মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। দরিদ্রদের প্রতি তাচ্ছিল্যভাব ফুটে উঠেছে। অথচ এ বই যারা পড়বে তাদের বিরাট একটি শ্রেণীই হলো দরিদ্র ও সাধারণ পরিবারের সন্তান। কিশোর অপরাধের জন্য তাদেরকে যেভাবে দায়ী করে বিবরণ দেয়া হয়েছে তাতে তারা যখন এটি পড়বে তখন তাদের মনোভাব কী হবে সেটা বিবেচনা করলে খুবই খারাপ লাগে। তাদের মনটা ছোট হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

লেখাটিতে যেসব অপরাধকে কিশোর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো চুরি, খুন, জুয়াখেলা, স্কুল পালানো, বাড়ি থেকে পালানো, পরীক্ষায় নকল করা, বিদ্যালয়ে ও পথেঘাটে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করা, পকেট মারা, মারপিট করা, বোমাবাজি করা, গাড়ি ভাঙচুর, বিনা টিকিটে ভ্রমণ, পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, অশোভন ছবি দেখা, মাদক গ্রহণ ইত্যাদি। আমাদের দেশের কিশোর অপরাধীরা সাধারণত এসব অপরাধের সাথে জড়িত থাকে। এ ছাড়া অনেক সময় দলবেঁধে ডাকাতি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করে থাকে।

কেউ কেউ অভিযোগ করলেন, বর্তমানে কিশোর অপরাধের অন্যতম প্রধান অনুষজ্ঞ হলো প্রযুক্তি। আর সাধারণত এর অধিকারীও সমাজের ধনিক ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা। তবে প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণেও সাধারণ আয়ের পরিবারের অনেক সন্তানরাও এসব পণ্য ব্যবহার করতে পারছে। এসব প্রযুক্তির নানা ধরনের অপব্যবহারজনিত নিত্যনতুন অপরাধের জন্ম নিচ্ছে। প্রযুক্তি কেন্দ্রিক নানা ধরনের কিশোর অপরাধ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে। অথচ এ বিষয়ে মাত্র একটি লাইনে বক্তব্য শেষ করা হয়েছে বইটিতে। এ বিষয়ে লেখা হয়েছে ‘বর্তমানে মোবাইল ও ইন্টারনেটের অপব্যবহারের ফলেও সমাজে এক ধরনের কিশোর অপরাধ দেখা যাচ্ছে।’

এ বিষয়ক অপরাধ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ থাকার দরকার ছিল বলে মনে করেন অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রামপুরার একজন ভাড়াটিয়া বলেন, আমার বাড়িওয়ালা তার ছেলেকে ছাদে একটি রুম বানিয়ে দিয়েছে। একাদশ শ্রেণী পড়–য়া বাড়িওয়ালার এই ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিত সেখানে। ছাদে কোনো ভাড়াটিয়াদের যেতে দেয়া হয় না। সেখানে তারা নানা ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম করে বলে অনেকের সন্দেহ। এমনকি একদিন সেখানে এক মেয়েকেও নিয়ে যেতে দেখা গেছে। পরে ভাড়াটিয়ারা তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এর প্রতিবাদ জানানোয় বাড়িওয়ালা তার ছেলের ছাদের আড্ডাখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এভাবেই অনেক মা বাবার প্রশ্রয়ে সমাজে অনেক উচ্চবিত্তের সন্তান উচ্ছন্নে যাচ্ছে, নানা ধরনের অপকর্মের সাথে যুক্ত হচ্ছে।

অনেক অভিভাবক বলেন, বর্তমানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অনেক কিশোর অপরাধের সাথে দারিদ্র্য এবং দরিদ্র পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/399154