১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৭:০৫

রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো তিন ব্যাংকের অনুমোদন

দেশের আর্থিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকরা। এরপরেও গতকাল রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো তিন ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো হচ্ছে- বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক ও পিপলস ব্যাংক। এ নিয়ে দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা হবে ৬২।

অনুমোদন পাওয়া বেঙ্গল ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা হলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোর্শেদ আলম। তার প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। মোর্শেদ আলম এ গ্রুপের চেয়ারম্যান। এ গ্রুপের নামেই ব্যাংকটির নাম দেয়া হয়েছে বেঙ্গল ব্যাংক। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে মোর্শেদ আলমের ছোট ভাই জসীম উদ্দিনকে। আর সিটিজেন ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা হলেন আইন মন্ত্রী আনিসুল হক। এ ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে আনিসুল হকের মা জাহানারা হককে। পিপলস ব্যাংকের উদ্যোক্তা হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা এম এ কাশেম।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আকার ও ভৌগলিক বিবেচনায় এত ব্যাংকের প্রয়োজন না হলেও লাইসেন্স নিয়ে নতুন ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করছে। ঋণ ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকের পরিচালকরা। নিজের ব্যাংকের পাশাপাশি নিচ্ছেন অন্য ব্যাংক থেকেও। আবার বেনামেও ঋণ নিচ্ছেন কেউ কেউ। বর্তমানে এ ধরনের বেশির ভাগ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো। এমনি পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো তিন নতুন ব্যাংক দেয়ায় আরো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও কাম্য নয়।
সরকারের বিগত মেয়াদে ব্যাংকগুলো অনুমোদনে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তারপর কয়েক দফা পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করা হলেও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়নি। গতকাল রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এসব ব্যাংকের নামে আগ্রহপত্র (লেটার অব ইনট্যান্ড) দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে নতুন এসব ব্যাংক স্থাপন করতে উদ্যোক্তাদের মূলধন জোগান দিতে হবে ৫০০ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মো: নাসের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, পর্ষদ সভা থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে অপেক্ষায় থাকা তিনটি ব্যাংকের অনুমোদনের। তবে পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে এই তিনটি ব্যাংকের জন্য ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।

এর আগে গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় এসব ব্যাংক অনুমোদনে নীতিগত সায় মিলে। এরপর কয়েকবার পর্ষদ সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। তবে আবেদনে ক্রুটি ও পর্যাপ্ত কাগজপত্র না থাকায় অনুমোদন মেলেনি। এরপর উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা মোতাবেক শর্ত পূরণ করেন।

জানা গেছে, দেশ পরিচালনায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার তিন মেয়াদে এ নিয়ে ১৩টি ব্যাংকের অনুমোদন দিলো। যার ৯টি দেয়া হয় সরকারের প্রথম মেয়াদে। একটি দ্বিতীয় মেয়াদে। আর তিনটি তৃতীয় মেয়াদের শুরুতেই। এ ছাড়া, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংক করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সর্বসম্মতভাবে তিনটি ব্যাংক অনুমোদন করেছে। ব্যাংকগুলোর উপস্থাপিত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত হয়।

জানা গেছে, আমানত রেখে তা ফেরত পাচ্ছে না নতুন প্রজন্মের ব্যাংক ফারমার্স থেকে। পরে পদ্মা নামে ব্যাংকটি নতুন নাম ধারণ করে। নতুন প্রজন্মের অন্য ব্যাংকগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

বর্তমানে অনেকটা আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে গ্রাহকের মধ্যে। বেশি মুনাফার প্রলোভন দিয়েও আমানত প্রত্যাহার ঠেকাতে পারছে না নতুন ব্যাংকগুলো। শুধু সাধারণ গ্রাহকই নন; সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নতুন এ ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নতুন ব্যাংক থেকে তহবিল প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। আর নতুন আমানত বলা চলে আসছেই না। এমনি পরিস্থিতিতে সরকারের আবারো নতুন তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন অর্থনীতির জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের শেষ সময়ে এ তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন এ তিন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ার আগে স্বয়ং অখুশি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। গত ১ নভেম্বর অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। এরপরও চারটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। তিনি বলেন, এভাবে ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় আমি খুবই অখুশি। এর আগেও গত ২৪ অক্টোবর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষেও সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাত খুব বেশি বড় হয়ে গেছে। অনেক ব্যাংক অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দু’টিই বেশি। এটা মনে হয় একটু সীমিতকরণ (কনসুলেশন) দরকার হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বার বার বলে আসছে বর্তমান অর্থনীতিতে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু সরকারের বাইরে নয়, তাই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক তার অবস্থান ধরে রাখতে পারে না। সরকারের সদিচ্ছার কারণে বিএনপির আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার সিদ্ধান্ত ধরে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে যেখানে অর্থমন্ত্রীর মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয় না, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মতামত দিয়ে বেশি দূর যেতে পারে না। নতুন ব্যাংক দেয়ার সরকারের সিদ্ধান্তকেই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/389395