যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ল’ স্কুলের প্রফেসর নোয়াহ ফেল্ডম্যান যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের নিয়মিত কলাম লেখক। এছাড়া তিনি মার্কিন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স নামক সংস্থার একজন সিনিয়র ফেলো। ২০০৮ সালে প্রকাশিত তাঁর The Fall And Rise Of The Islamic State গ্রন্থটি পাঠকমহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই বইয়ে ফেল্ডম্যানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, “মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রবণতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী আন্দোলনের গতি সে সব দেশে তীব্রতর হচ্ছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামী দলগুলো বেশ সক্রিয় থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোথাও ইসলামপন্থীদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে বা ক্ষমতা গ্রহণ করতে দিলেও ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হয়নি। তারা ক্ষমতায় গিয়ে সরকার পরিচালনায় তাদের যোগ্যতা জনগণকে দেখানোর যথেষ্ট সুযোগ পায়নি। সাম্প্রতিক মিসর এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এজন্য জনগণ যে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এমনটি নাও হতে পারে; যেহেতু জনগণ দেখছে যে, তাদেরকে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না।
অন্যদিকে নানা কৌশলে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক শক্তি প্রয়োগ এবং গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে যারা পরাস্ত করতে চাইছে, তারা অতি মাত্রায় স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা চর্চা করছে; যদিও দৃশ্যত তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করছে। এর উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এ বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, ইসলামপন্থীরা যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়, তাহলে জনগণ হয়ত তাদেরকেই বার বার ভোট দেবে। তবে তার জন্য তাদের যেমন নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক আন্দোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে হবে, তেমনি সমাজে উপস্থিত নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সকল শক্তির এ ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে”।
এ সময়ের অন্যতম বুদ্ধিজীবি নোয়াহ ফেল্ডম্যান এর পর্যবেক্ষণই যে আজকের বাস্তবতা। সেই চিত্রটিই ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীর নব-নির্বাচিত আমীর জননেতা জনাব মকবুল আহমাদ এর বক্তব্যের মধ্যে সেই চিত্রটি ফুটে উঠেছে।
মূলত একটি বক্তব্য মানুষের মনে কতটুকু আবেদন তৈরি করতে সক্ষম তা বিবেচিত হয় তিনি কি বলছেন সেটি দিয়ে। বক্তব্যের ভাব, সার্বজনীনতা, উদারতা, দেশপ্রেম ও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে কথা বলতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। বক্তব্যে যদি হিংসা, বিদ্বেষ ও জিঘাংষা মুক্ত হয় তাহলে তা হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। এজন্য বক্তব্যকে বলা হয় যাদু। দুনিয়ায় প্রেরিত সকল নবী-রাসূলগণই বাগ্মীতায় ছিলেন সেরা। কারণ তাদের দায়িত্বই ছিল মানুষের মধ্যে সত্যের আবেদন পেশ করা। মানুষের হতাশা দুর করে সাড়া জাগানো। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে অগ্রসরমান আদর্শ ইসলাম। আদর্শ নিজেই একটি শক্তি। আজকের দুনিয়ায় এটি সর্বত্র ফ্যাক্টর হিসেবেই টিকে আছে।
ইসলাম সারা দুনিয়ার সামনে আলোচিত এজেন্ডা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত জীবনাদর্শ। সুতরাং এই আদর্শের প্রতিনিধিত্ব যারা করেন তারা কখনো আলোচনা-সমালোচনার বাহিরে থাকেননি। ইসলাম সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে পরিবর্তনের কথা বলে। সে পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের পরিবর্তন। মনুষত্ব্যের বিকাশ ও অ-কল্যাণের ধ্বংস করা। মহাগ্রন্থ আল্-কুরআনে বলা হয়ছে-“আল্লাহ অবশ্যই কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।” (১৩:১১)
মাওলানা মতিউর নিজামীর শাহাদাতের মাধ্যমে আমীরে জামায়াতের শূণ্য পদের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জামায়াতের নতুন আমীরের নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া জনসমর্থনের দিক থেকেও জামায়াতে ইসলাশী দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী ও তৃতীয় রাজনৈতিক দল। বিগত দিনে জামায়াত অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সরকার পরিচালনায় অংশ গ্রহণ ছিল দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের আলোচনার মুল কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিনিয়ত হামলা-মামলা, দমন-নিপিড়ন, গুম, খুন, এত কিছুর পরও জামায়াতের আমীর নির্বাচন নিয়ে সর্বমহলে ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি হয়। জামায়াত নিজেদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা শত প্রতিকুলতার মাঝে ও কিভাবে লালন করে এ নির্বাচন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
জামায়াতের নব-নির্বাচিত আমীরের বক্তব্য দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া ও স্যোসাল মিডিয়া, টকশো সব জায়গায় চুলচেরা বিশ্লেষণ অব্যাহত। নিউজের হেডলাইন হচ্ছে - “জামায়াতের আমীরের বক্তব্যে পরিবর্তনের সুর” কেউ বলছেন, “আগামীর পথে জামায়াত” কেউ বলছেন, “যুদ্ধাপরাধ মুক্ত জামায়াত” আবার কেউ বলছেন, “ক্লিন ইমেজের মকবুল আহমদের নেতৃত্বে জামায়াত” এ রকম নানা শিরোনামে নিউজ করছে অনেকে মিডিয়া। কতিপয় মিডিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমীরের শপথ নেয়ার কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তাঁকে রাজাকার কমান্ডার বানিয়ে, যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা মিথ্যা, কাল্পনিক বলে জামায়াত প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই ষড়যন্ত্র মূলক কল্পকাহীনি দেশের জনগণ প্রত্যাখান করেছে।
জনাব মকবুল আহমাদ কর্মজীবনে একজন সফল শিক্ষক। তৃণমুল থেকে উঠে আসা দ্বীনের এই নিবেদিত প্রাণ মানুষটি এ দেশের জনগনের নিকট খুবই পরিচিত। ব্যাক্তি জীবনে তিনি বিনয়ী, অল্পেতুষ্ট, পরোকারী, স্বজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই তিনি সকলের হৃদয়ে আস্থার জায়গা করে নিয়েছেন আপন মহিমায়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানিকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃনা করেন। তিনি সত্যিই একজন সাদামনের মানুষ। যারা তাঁর সাথে মিশিছেন তারাই এর সাক্ষী। দেশের বিরাজমান সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবেলায় তিনি যে, বস্তুনিষ্ঠ, সময়োপযোগী ও জনগণের মনের ভাষাকে উপলদ্ধি করে, যে ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছেন তা সত্যিই বিরল।
গোটা দেশ যখন নেতা-কর্মীদের ও জনগণের রক্তে রঞ্জিত। মজলুমের আহাজারিতে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্ভিত। তাঁর বক্তব্যের ভাষা সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী কিন্তু প্রচন্ড শক্তিশালী। তিনি আবেগ তাড়িত হননি কিন্তু আবেগের সম্মোহনী শক্তি বিতরণ করেছেন। তাঁর বক্তব্যে গোটা দুনিয়ার মজলুম বঞ্ছিত, শোষিতদের পক্ষে বলিষ্ঠ সাহসীপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি এই মহান দায়িত্ব থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সংগঠনের এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষনের রুকনদের (সদস্য) দেয়া দায়িত্ব মর্যাদার সাথে বরণ করেছেন। জাতির এই ক্রান্তিকালে তাঁর এই ঐতিহাসিক বক্তব্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আমেরিকার ইতিহাসে যে ক’জন জ্ঞানী ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে তাদের মধ্যে উইলিয়াম জেম্স এর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তার বক্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিধর। উইলিয়াম জেম্স বলেছেন,“আমার প্রজন্মের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো যে, মানুষ তার মনোবৃত্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।” জনাব মকবুল আহমাদ সাহেবের বক্তব্য তারই সাক্ষ বহন করে।
এ নিয়ে স্যোসাল মিডিয়ায় কয়েকজনের মন্তব্য ছিল এমন। এস এম টিপু সুলতান লিখেছেন- “যে নির্বাচনে নিয়ে দলের মধ্যে কোন বিরূপ ধারনা থাকে না, যে নির্বাচনে জয়ী হয়ে নেতা বলেন না যে তিনিই সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী ছিলেন, যে নির্বাচনের কমিশনারদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকেনা, যে নির্বাচনে সবাই জয়ী হয়, হেরে যাওয়া প্রার্থীগণও, তেমন নির্বাচন শুধু একটা দলই করতে পারে। যে দলে সভাপতির ছেলে সভাপতি হয় না, যেখানে যোগ্যতার প্রমান দিয়ে নেতা হতে হয়।”
শপথ পরবর্তী বক্তব্যে জনাব মকবুল আহমাদ এই মহান দায়িত্ব সম্পর্কে অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন-“জামায়াতে ইসলামীর আমীরের এ কঠিন দায়িত্ব হতে আমি নিজেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলাম। এই কঠিন জিম্মাদারী পূর্ণ আমানতদারীর সাথে যথাযথভাবে পালনের শক্তি ও সক্ষমতার জন্য মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট দুই হাত তুলে নিবেদন করেছি। অতীতে আমার জীবনে বড় কোন পার্থীব চাওয়া-পাওয়া ছিলনা, এখনও নেই। মহান রব আমাকে যদি তার দ্বীনি আন্দোলনের জন্য কবুল করে থাকেন, তবে এটাই হবে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমার ব্যক্তিগত পছন্দ ও যাবতীয় চাহিদার উপর সংগঠনের স্বার্থ এবং দেশ ও জাতির প্রয়োজনকে স্থান দিতে পারি, সেই জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের খাস রহমত এবং আপনাদের দোয়া ও সহযোগীতা কামনা করছি”।
এনায়েত হোসাইন- “আমরা আছি আপনার সাথে বাংলার জনগণ আছে আমাদের সাথে, আপনি আপনার মত করে নয় আপনার নীতি হবে বাংলার ১৬ কোটি মানুষের প্রানের নীতি, আপনি অবশ্যই সফলকাম হবেন এই আমাদের আশা, বাতিল আছে থাকবে কিন্তু বাতিলকে কখনও সামনে আসতে দেওয়া হবেনা ইনশাআল্লাহ।” জোনায়েদ হোসাইন- “আল্লাহ উনাকে নেক হায়াত দান করুন এবং দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন।”
গত ১৭ অক্টোবর সোমবার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচিত আমীর জনাব মকবুল আহমাদ শপথ গ্রহণ করেন। জামায়াতে ইসলামীর রুকনগণ (সদস্য) গোপন ভোটের মাধ্যমে ২০১৭-২০১৮-২০১৯ কার্যকালের জন্য জনাব মকবুল আহমাদকে আমীর হিসেবে নির্বাচিত করেন। আমরা দেশের সকল জনগনের পক্ষ থেকে না নির্বাচিত আমীরকে আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
শপথ অনুষ্ঠানের বক্তব্যে তিনি বলেন- “প্রথমেই আমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। সেই সাথে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সকল জনগণ ও বীর মুক্তিযুদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ভুমিকা ও অকৃত্রিম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি তাদের কথা আজ গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। বিশেষভাবে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি উসমানী সহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল অবিসংবাদিত নেতাদের আমি স্বশ্রদ্ধচিত্তে স্বরণ করছি।
আজকের এই মুহুর্তে গভীর শ্রদ্ধার সাথে আরও স্মরণ করছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক আমীর ও মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সহ সেই সকল শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে, যারা আমাদের প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটি ইনসাফপূর্ণ ও কল্যাণমুখী সমাজ বিনির্মাণের জন্য আজীবন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন। আর একারণে বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিহিংসামূলকভাবে তাদের পাঁচজনকে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। দুইজন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে জুলুমের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
তিনি বলেন- ফিলিস্তিন, মিশর, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক সহ বিশে^র বিভিন্ন রাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কবলে পড়ে যে সকল মানুষ হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, তাদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। কাশ্মিরের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে যৌক্তিকভাবে মেনে নিয়ে স্থায়ী শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানাচ্ছি। মায়ানমারের নিপীড়িত মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সে দেশের সরকার এবং বিশ^ সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন- আমাদের প্রিয় জন্মভুমি এক কঠিন সংকটের মুখে নিমজ্জিত। দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না থাকায় গণতন্ত্র অবরুদ্ধ ও মানবাধিকার ভুলুন্ঠিত। জনগণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোকে ইসলামী দল সহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে নগ্নভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে কার্যত একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। সন্ত্রাস ও চরমপন্থা দমনে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় জনগনের মধ্যে হতাশা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে। গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ, অপসংস্কৃতির সয়লাব ও নৈতিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। গুম, খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদক ও চোরাচালান ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, লুটপাট, দলীয়করণ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অনৈক্য, মিথ্যাচার ও দমন পিড়ন ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আজ সরকারী দলের দুর্বৃত্তদের লুটপাট, দখলদারিত্ব ও নির্যাতনের কারণে অনিরাপদ এবং অতিষ্ট। দারিদ্র, বেকারত্ব, মেধার অবমূল্যায়ন, বৈষম্য, নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা জনজীবনকে নাবিশ্বাস করে তুলেছে। দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলয় ভেঙ্গে পড়েছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা -বাণিজ্যের অঙ্গনগুলো সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন- এ দেশটি আমাদের সকলেরই। দেশে বিরাজমান সমস্যা ও সংকটের সমাধান আমাদের সবাইকে মিলেই করতে হবে। কোন একটি দলের পক্ষে কিংবা একা সরকারের পক্ষে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। দল ও মতের উর্ধ্বে উঠে সকলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে চলমান সংকট ও সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহনের জন্য আমি সরকারের প্রতি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি। আর এজন্য সকল দল ও পক্ষের অংশগ্রহণে একটি সফল জাতীয় সংলাপের কোনই বিকল্প নেই। একই সাথে অতীতের কোন রাজনৈতিক বিষয়কে অজুহাত না বানিয়ে সকল দু:খ, কষ্ট ও বেদনাকে ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন- আমাদের প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। প্রাকৃতিক, খনিজ ও মৎস্য সম্পদ সহ মানব সম্পদে ভরপুর প্রিয় এ্ই দেশ। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য দরকার সুশাসন ও সুবিচারপূর্ণ সমাজ এবং সততা, নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় যোগ্যতা সম্পন্ন মেধাবী এবং দক্ষ দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সেই কাঙ্খিত মানের নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত মূলনীতি ও ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সুশাসন ও ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণধর্মী সমাজ বিনির্মানের জন্য কাজ করছে। দেশের বিদ্যমান পরিবেশ পরিস্থিতি সহ আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সেই কাঙ্খিত জনকল্যাণমূলক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে জামায়াত তার রূপকল্প হিসাবে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পণা গ্রহণ করেছে।
‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি শত্রুতা নয়’, এই নীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো সহ বিশ্বের শান্তিকামী সকল রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক এবং বাংলাদেশের জাতীয়স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে রাষ্ট্র সমূহের সাথে সমতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মসহ দেশের জনগণের কাঙ্খিত উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্টার স্বপ্ন পূরণ হবে, ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন- “সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত সকলকে ইসলামের নামে যেকোন ধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। সারা দুনিয়ার সকল ধর্মাবলম্বীদের জামায়াতে ইসলামী সম্মান ও মানবিক দৃষ্টিতে দেখে। তাই আমরা রাজনীতি কিংবা ধর্মের নামে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও নিরীহ মানুষ হত্যা এবং জুলুম নির্যাতনের অবসান চাই। একই সাথে উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক আচরণ দিয়ে আমরা সকল প্রকার বিরোধীতার মোকাবেলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা দেশ-বিদেশের সকল শান্তিকামী মানুষের মঙ্গল কামনা করি”।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নব-নির্বাচিত আমীর, জাতির মহাদুর্যোগের নব কান্ডারী, ইসলামী আন্দোলনের অভিভাবক, দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, জনাব মকবুল আহমাদ দেশের স্বাধীনতা, শান্তি-শৃংখলার স্বার্থে জাতীয় ঐক্যের যে আহবান জানালেন তা দেশে-বিদেশে সর্বমহলে প্রসংশিত ও সমাদৃত হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের মৌলিক উপাদান শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, পরমত সহিষ্ণুতা ও দেশপ্রেম। এই বক্তব্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা এর মাধ্যমে জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে। ইতিহাস একদিন তাঁর মূল্যায়ন করবে। পৃথিবীতে ইতিহাসের লেখক, পাঠক অনেকেই হন কিন্তু ইতিহাসের রচয়িতার সংখ্যা দু’এক জনই।
দেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজকে দায়িত্ব পালনে তাঁর এ যুগান্তকারী বক্তব্য সাহস যোগাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দেশেক প্রত্যেক সম্মানিত নাগরিককে দেশ ও জাতির স্বার্থে নিজ-নিজ দায়িত্ব পালনে আপনারা সচেষ্ট হবেন এটাই জনগণের প্রত্যাশা। তাছাড়া ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কমী, শভাকাংখী ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য আমাদের শ্রদ্বেয় আমীরে জামায়াত যে নসিহত পূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন তা সত্যিই প্রেরণার মাইল ফলক।
পৃথিবীতে মানুষই কেবল পারে যত জীর্ণ পুরাতন, ক্লান্ত, শ্রান্ত বিবর্ণ-মলিন চিন্তা ও ধারণাগুলোকে ধুয়ে মুছে ফেলতে। আনতে পারে নতুন দিনের শুভাগমন। নির্ভেজাল, সৃজনশীল, বিশ্বাস, চিন্তায় এবং সৎ গুণাবলীতে মনকে ভরে ফেলতে পারে। এই পথ ধরেই আসতে পারে ব্যাক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তন। “সেবার জন্য নেতৃত্ব”। হযরত আলী (রা:)-এর এই ঐতিহাসিক উক্তিকে কেউ যদি ধারণ করে অগ্রসর হতে পাওে তাহলে অপরুপ মহিরুহে সুশোভিত হবে এ সমাজ ও বিশ্ব।
তাই মাবুদের দরবারে ফরিয়াদ, হে প্রভু! তোমার শান্তি প্রবাহিত হোক, যেন আমরা যেখানে ঘৃণা, সেখানে প্রেম আনতে পারি, যেখানে অন্যায় সেখানে ক্ষমা আনতে পারি, যেখানে বিরোধ সেখানে মৈত্রী আনতে পারি, যেখানে ভ্রান্তি, সেখানে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যেখানে সংশয়, সেখানে বিশ্বাস আনতে পারি, যেখানে হতাশা, সেখানে আশা আনতে পারি, যেখানে ছায়াচ্ছন্নতা, সেখানে আলো আনতে পারি, যেখানে বিষাদ, সেখানে আনন্দ আনতে পারি। হে প্রভু! আমাদের যোগ্য করো, আমরা যেন শহীদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ আঞ্জাম দিতে পারি। আমরা যেন মজলুম মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারি সে হিম্মত, সাহস ও শক্তি আমাদেরকে দান কর।
কাজী নজরুলের ভাষায়-
''দূর্গম গিরি কান্তার-মরু,
দুস্তর পারাবার/ লঙ্গিতে হবে
রাত্রি নিশীতি, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!''