আমীরে জামায়াত

2022-04-09

চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের দিনব্যাপী রুকন শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত

সোনালী সমাজ বিনির্মাণে সদস্যদের (রুকন) শপথের আলোকে কাংখিত মান অর্জন করতে হবে

-ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর উদ্যোগে দিনব্যাপী এক রুকন শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। কেন্দ্রীয় এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর মুহাম্মদ শাহজাহানের সভাপতিত্বে শিক্ষাশিবিরে আরো বক্তব্য রাখেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা'ছুম, এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুর রব।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, নৈতিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, পশুত্বের যা আচরণ সব শয়তানের। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আমাদের নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন এবং সত্যের সাক্ষ্যদাতা বানিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামী সেরকমই সত্যের সাক্ষ্য দেয়ার দল। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমে সোনালী সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

দেশে এখন ১৮ কোটি মানুষ, যার প্রায় ৯০ ভাগই মুসলিম জনগোষ্ঠী। অথচ এই মুসলিমদের নেতৃত্বের আসনে বসে কাজ করা হচ্ছে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী। তারা চায়, ইসলাম শুধু কিছু নামায, তাসবীহ-তাহলীলের মধ্যে পড়ে থাকুক। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম চর্চা হোক, এটা তারা পছন্দ করে না। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। হাজার কোটি টাকা লুটের মধ্যেই তারা সুখ খুঁজে পায়, অথচ আমরা জানি এতো টাকা লুট করার পরও তারা রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। সব সময় এই লুটের টাকা হারিয়ে ফেলার আশংকা তাদের তাড়া করে। তারা হতভাগা, তারা জানে না অর্থ মানুষকে শান্তি দিতে পারে না। শান্তি আসে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে।

প্রতিটি কাজের জন্য সহীহ নিয়ত এবং একই সাথে প্রয়োজন সহীহ কর্মপদ্ধতি। এই দুটি জিনিস যাদের আছে তারা আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয়। এরা সংখ্যায় কম হলেও এরা শক্তিশালী, সাহসী। কারণ এদের সাহায্যকারী স্বয়ং আল্লাহ। বিশাল আরবের বুক চিরে জন্ম হয়েছিল রাসুল সা. এর। তিনি ছিলেন সত্যবাদী, আমানত রক্ষাকারী। অথচ তিনি যখন সত্যের দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন তখন তাঁর জাতি সেটি মেনে নেয়নি, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। সংখ্যায় কম হলেও রাসূল সা. এবং সাহাবীদের দল ছিল শক্তিশালী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও আজ ব্যতিক্রম নয়। আমরা যতই সংখ্যায় কম হয় না কেন, আমরা আমাদের সহীহ নিয়ত ও সহীহ কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্যে সোনালী সমাজ বিনির্মাণ করব ইনশাআল্লাহ।

দুর্নীতি আমাদের পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। মানুষের জীবন-সম্পদের যেন কোনো নিরাপত্তা নেই। রাতের ভোটের সরকার জনগণের মুখ চেপে ধরে বলছে দেশ ভালো চলছে, চারদিকে যেন কবরস্থানের নিস্তব্ধতা। সরকার ইতিহাস ভুলে গেছে, অবশ্য ইতিহাসের শিক্ষা এটাই যে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। বাংলাদেশকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ছিনিমিনি খেলছে। ভূরাজনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ বাংলাদেশ, ছোট্ট দেশ হলেও নেয়ামতে ভরা। আমাদের প্রত্যেকের অন্তর আর হাত যদি পরিষ্কার থাকে, তাহলে এই দেশ অন্য এক উচ্চতায় চলে যাবে। আরেকটি অবৈধ নির্বাচনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে বিলীন করা হচ্ছে, ইতোমধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে। সব মিলে পুরো দেশে চলছে ভয়ংকর নৈরাজ্য।

এমতাবস্থায় রুকন হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অনেক, দেশকে অমুক মডেল, তমুক মডেলে পরিণত করার কথা আমরা বলব না, আমরা দেশে ঐ মডেলই কায়েম করব, যা রাসূল সা. কায়েম করেছেন। জামায়াতে ইসলামী তার নীতি-পদ্ধতি এভাবেই সাজিয়েছে। একজন রুকন হিসেবে আমাদের পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করতে হবে, বিনয়ের সাথে পথ চলতে হবে, আমিত্ব পরিত্যাগ করতে হবে। রুকনরাই সংগঠনের প্রাণ, সংগঠনের চার দফা কর্মসূচী রুকনদেরকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। কুরআন নাযিলের এই মাসে আমাদের বেশী বেশী তাওবা করতে হবে, মানবতার জন্য কাজ করতে হবে, সব মানুষকে হকের দাওয়াত দিতে হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করাকে ইবাদাত মনে করতে হবে। কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে আওয়ামীলীগ, কে বিএনপি সেটা বিবেচনা করে কাজ করা যাবেনা। আল্লাহর রাসুল বলেছেন তোমাদের মধ্য সেই উত্তম যে মানুষের কল্যাণে কাজ করে। জামায়াতে ইসলামীকেই সেই দায়িত্ব নিতে হবে, আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করুন আল্লাহ যেন জামায়াতে ইসলামীকেই এই দেশের দায়িত্ব তুলে দেয়।

সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, নবীগণ হচ্ছেন মানবজাতির জন্য আদর্শ। তাদের জীবনী থেকে আমাদের অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় ঠিক করে জীবন পরিচালনা করতে হবে। তাদের দাওয়াত ছিল আল্লাহর দিকে মানবজাতিকে আহ্বান। আম্বিয়াকেরামের যুগেও কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সংঘাত হয়েছে। ভোগ নয় ত্যাগই ছিল তাদের জীবনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমাদেরকে দুনিয়ামুখী নয় আখেরাতমুখী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে।

কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুর রব বলেন, সঠিকভাবে শপথের দাবী পূরণ করেই নিজের জীবন অতিবাহিত করতে হবে। ইসলাম হচ্ছে জীবন বিধান, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের চেষ্টা করতে হবে।তিনি তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনকে শক্তিশালি করার আহ্বান জানান।

শিক্ষাশিবিরে কুরআনের দারস পেশ করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম। তিনি বলেন, আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য। আমাদের জীবনে উত্তান-পতন সফলতা-বিফলতা বিপদ-আপদ অনেক কিছু আসবে, এসব ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করে আল্লাহর গোলাম হবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনে তাকওয়া অবলম্বনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও নগর আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, আমরা বর্তমান যে সময়টি পার করছি তার যেমন নেতিবাচক দিক আছে, তেমনি আবার কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। আমরা একটানা এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে না পড়লে নিজেদের সত্যিকার অর্থে যাচাই-বাছাই করতে পারতাম না। আমরা ঈমানের দাবীতে কতটা সত্যবাদী, আম্বিয়া আলাইহিস সালামরা তাদের দায়িত্বের হক কীভাবে পালন করেছেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করছি কিনা- এটা নিরুপণ করার জন্য এই ধরণের পরিস্থিতি আমাদের সাহায্য করেছে। এরকম অব্যাহত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের নিজেদেরকে আত্মপর্যালোচনা করতে হবে যে একজন রুকন হিসেবে আমরা আমাদের সার্বিক মান কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি। আজকের শিক্ষাশিবিরের আলোচনা, দরসে কুরআনকে সামনে রেখে আমাদের এই পর্যালোচনাটি সকলের করা উচিত। দ্বিতীয় যে কথাটি বলতে চাই, আল্লাহর এই দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য নবীরা প্রস্তুতি নিতেন, স্বয়ং রাসূল সা. প্রস্তুতি নিতেন, অথচ নবীদের উপর আল্লাহর ওহী আসত। ওনারা দাওয়াতের প্রস্তুতি নিতেন, আমল করে নিজেদের প্রস্তুত করতেন, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করতেন, সকল অবস্থায় ধৈর্য্য ধারণের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। আজকে আমরাও তো দ্বীন কায়েমের দায়িত্ব পালন করছি। আমাদেরকেও দাওয়াতি ময়দানের উপযোগী করে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। এছাড়া ত্যাগ কুরবানীর ময়দানে, শৃঙ্খলার দিক দিয়ে আমরা কতটুকু এগিয়েছি তা পর্যালোচনা করা উচিত। পরিপূর্ণ ভাবে নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিতে হবে। এই শিক্ষাশিবির থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে নতুন ভাবে প্রস্তুত করতে হবে। মানুষ যাতে আমাদেরকে দেখে সত্যিকার ভাবে অনুপ্রাণিত হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে। মাহে রমাদান অতিবাহিত হচ্ছে, আমরা বুঝে ওঠার আগেই মাহে রমাদান শেষ হয়ে যাবে, সংগঠন থেকে যে ধরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং ব্যক্তিগত পরিকল্পনার আলোকে এই মাসটা কাটাতে হবে। আমাদের জনশক্তিকেও সেই আলোকে কাটানোর প্রেরণা দিতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ জমিনে সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদেরকে পেশ করে যার উপর যে দায়িত্ব আছে তা আঞ্জাম দিয়ে দ্বীনি দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান নগর আমীর।

দিনব্যাপী রুকন শিক্ষাশিবির মহানগর নায়েবে আমীর আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ, সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমীন ও সহকারী সেক্রেটারি ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুছের সঞ্চালনায় ডেলিগেটদের মধ্য থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়।