২ আগস্ট বুধবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঘোষিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেশে বিদ্যমান সংঘাতমুখর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার এবং কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে বক্তব্য রাখেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ-এর সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আবদুর রহমান মুসা প্রমুখ। দেশবাসীর উদ্দেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ-
“প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
সরকারের সৃষ্ট সংঘাতমুখর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা জানেন, বর্তমান সরকার কাউকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও মিটিং-মিছিল করতে দিচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের দিন সরকারি দল পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। সরকারের দায়িত্ব হল দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সরকার তার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধীদলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ২০১৪ ও ২০১৮ স্টাইলে আরেকটি নির্বাচনের নামে প্রহসন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। এই লক্ষ্য হাসিলের জন্য তারা জামায়াতে ইসলামীকে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করতে দিচ্ছে না। সরকারের জেনে রাখা উচিত জনগণ কোনো প্রহসনের নির্বাচন মেনে নিবে না।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হচ্ছে সংবিধান। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সংবিধানের দ্বারা। সংবিধান জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকারের বিষয়ে যে নিশ্চয়তা দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব হচ্ছে প্রশাসনের। বাংলাদেশের সংবিধানে যে সব বিষয় লিপিবদ্ধ রয়েছে তা হলো- ব্যক্তির অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা, সংঘ-সমিতি করার স্বাধীনতা, চিন্তা, বিচার-বুদ্ধি ও বাকস্বাধীনতা, পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা। সংবিধানের এসব অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হলে সে ব্যাপারে আইনী প্রতিকার পাওয়ার স্থান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
জামায়াতে ইসলামী সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী একটি রাজনৈতিক দল। সংসদে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব থাকা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াতের বিজয় প্রমাণ করে যে, জামায়াত দেশের তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে এবং জামায়াতকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার অপকৌশল হিসেবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াতের নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করে কিছু অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি রিট দায়ের করেন। ১/৮/২০১৩ তারিখে উচ্চ আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনটি আইন সম্মত হয়নি বলে রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে সংবিধানের ৩৮, ৩৯ এবং ৪১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়। জামায়াত আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং সম্মান রেখে তার আপিল আবেদনে উল্লেখ করেছে যে, উচ্চ আদালতের রায়টি সংবিধানের মৌল কাঠামোর পরিপন্থি। জামায়াতে ইসলামী মনে করে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানে বর্ণিত ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের অধিকারের ভিত্তিতে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবেন এবং আমরা আশা করি জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনী জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা লক্ষ্য করেছেন, উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকাবস্থায় জামায়াতের নিবন্ধন মামলা নিয়ে সরকার সমর্থিত কতিপয় ব্যক্তি নানাভাবে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রচার করছে। তারা আইন, আদালত, সংবিধান এবং দেশের প্রচলিত সিস্টেমকে অগ্রাহ্য করে আদালতের বিচার্য ইস্যুগুলো আদালতের বাইরে আলোচনায় টেনে এনে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। উচ্চ আদালতে জামায়াতে ইসলামী আপিলকারী এবং আপিলের বিষয় বস্তু হচ্ছে নিবন্ধন। নিবন্ধন সঠিক না বেঠিক কিংবা তার আইনী ফায়সালা কী- তার নিস্পত্তি করা আদালতের দায়িত্ব। অথচ জামায়াতে ইসলামীর দায়ের করা আপিলের বিষয়বস্তুর বাইরে কিছু লোক আদালত অবমাননা এবং জামায়াতকে রাজনীতি করতে না দেয়ার পিটিশন দায়ের করা সংক্রান্ত বিষয়গুলো মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জনগণের মধ্যে একটি উস্কানীমূলক পরিবেশ তৈরি করছে। আমরা সর্বদাই বলে আসছি, বিচারাধীন বিষয়ে আদালতের বাইরে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ সম্পর্কে আজ রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ কথা বলছেন। কোনো কোনো অতি উৎসাহী কর্মকর্তা বলছেন, যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন নেই, তাই জামায়াতের রাজনীতি করারও সুযোগ নেই। এই বক্তব্যগুলো সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থি। আমরা এসব বেআইনী, অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক আলোচনা পরিহার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
জামায়াতে ইসলামী একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। জামায়াত সব সময়ই শান্তিপূর্ণ উপায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নে অভ্যস্ত। জামায়াতের রাজনীতি করার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। এ অধিকার কেড়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলকে এ অধিকার দিয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, জামায়াতকে তার রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে না দিয়ে জামায়াতের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।
বিগত ১৫ বছর যাবত জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য সব ধরনের অপচেষ্টা চালিয়েছে এ সরকার। মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং দলীয় লোকদের মাধ্যমে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের ব্যবস্থা করে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির দ- দেয়ার ব্যবস্থা করে তা কার্যকর করেছে। বর্তমান আমীরে জামায়য়াত ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর জনাব সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীকে দীর্ঘ দিন যাবত কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে বারবার জামিন পাওয়া সত্ত্বেও সরকার তাদেরকে মুক্তি দিচ্ছে না। সরকার তাদেরকে মুক্তি না দিয়ে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে এবং অব্যাহতভাবে আদালত অবমাননা করে চলছে। কারাগারে আটক থাকাবস্থায় বাইরে সংঘটিত ঘটনায় জড়িয়ে মামলার আসামী করে তাদের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দেওয়া হচ্ছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অধিকারের ব্যাপারে নিবন্ধিত/অনিবন্ধিত বিতর্ক করার কোনো সুযোগ নেই। যে কোনো রাজনৈতিক দল সভা-সমাবেশ করার অধিকার রাখে। বাংলাদেশে বহু অনিবন্ধিত দল সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু জামায়াত অতীতের প্রায় প্রত্যেকটি সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল হওয়া সত্ত্বেও সমাবেশ করার সহায়তা পাচ্ছে না। এটা জামায়াতের প্রতি চরম অবিচার। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অন্য রাজনৈতিক দলের সাথে যে আচরণ করছে, জামায়াতের সাথে তার বিপরীত আচরণ করছে। এটা কোনো আইনের দ্বারা সমর্থিত নয়। আইন সকলের জন্যই সমান। অতএব, জামায়াতও আইনের দৃষ্টিতে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জামায়াতকে সে সুযোগ না দিয়ে সারা দেশে জামায়াত নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে সারা দেশে জামায়াতের সাত শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে মূল্যবান আসবাবপত্র ভাঙচুর ও তছনছ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহিলাদেরকে নাজেহাল করছে। কোনো কোনো এলাকায় পুরুষ নেতাকর্মীদের না পেয়ে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এসব কর্মকা- সম্পূর্ণ বেআইনী ও মানবাধিকার পরিপন্থি। মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের সেবক। তাদের কোনো দলের পক্ষে নয় বরং নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে দেশে আইনের শাসন বিঘ্নিত হবে এবং দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আরো ব্যাপক রূপ লাভ করবে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু সরকার জনগণের দাবি অগ্রাহ্য করে একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে দোষী সাব্যস্ত করে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার ষড়যন্ত্রে বিভোর। এ জন্য বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাত নয়টা পর্যন্ত সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার তার দলীয় লোকদের দ্বারা নানা অপপ্রচার চালিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন সংক্রান্ত বিচারাধীন মামলাটির বিষয়ে এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির অবতারণা করছে। সরকারের কোনো কোনো ব্যক্তি এবং ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটির কেউ কেউ এমন ভাষায় কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তারাই যেন নিবন্ধন বাতিলের কর্তৃপক্ষ বনে গেছেন। সরকারের এ সব আচরণ থেকে বোঝা যায়, সরকার জামায়াতকে আগামী নির্বাচনের বাইরে রাখার অপকৌশলের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে পরিস্থিতি আরো সংঘাতময় করার চেষ্টা করছে।
প্রিয় সাংবাবিদক বন্ধুগণ,
এ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা দেশ ও জাতির কাছে আহ্বান জানাতে চাই, সরকারের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার এবং কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী ঘোষিত ৪ আগস্টের সমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সফল করে তোলার জন্য আমরা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করছি।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
আল্লাহ হাফেজ।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জিন্দাবাদ।”