২ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১২:২৩

এলপিজির বিপজ্জনক ব্যবহার

সিলিন্ডারে ভবনের বিপদ বাড়ছে

নিয়মের মধ্যে আসছেন না গ্রাহক বিক্রেতা

বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনায় বিপজ্জনকভাবে ব্যবহার হচ্ছে তরলকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার। এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানিসহ ক্ষতি হচ্ছে সম্পদের।

কোনোভাবেই নিয়মের মধ্যে আসছে না গ্রাহক ও বিক্রেতা। এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের একটি বিধিমালা থাকলেও তা মেনে কেউ বাসাবাড়িতে সিলিন্ডার ব্যবহার করছে না। সূত্র মতে, দেশে কমপক্ষে ৫০ লাখ এলপি গ্যাস গ্রাহক রয়েছে। ছোট-বড় দুই শতাধিক কোম্পানির দেড় থেকে দুই কোটির বেশি সিলিন্ডার রয়েছে দেশে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে এলপিজি সিলিন্ডারজনিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৯৪টি, ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১২৫টি। অর্থাৎ সিলিন্ডার ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, গ্যাসের আগুনে পুড়ে গত বছরের জুন থেকে এ পর্যন্ত ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সিলিন্ডার আবদ্ধ ঘরে বেশি বিপজ্জনক। এছাড়া সিলিন্ডার থেকে চুলায় গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার যে প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করা হয়, তা দাহ্য পদার্থ হিসাবে চিহ্নিত। এতে বিপদ আরও বাড়ছে। কিন্তু বিধিমালায় এমন পাইপ ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। তারপরও ব্যবহার হচ্ছে, বাড়ছে দুর্ঘটনা।

সরেজমিন দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা উদ্যানের ৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির বেজমেন্টে দেওয়ালের পাশে ছোট-বড় ১৩টি সিলিন্ডার দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে ঝুলছে হলুদ রংয়ের পাইপ। এই পাইপ দিয়ে প্রতিটি ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে চুলার সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। নিচে এভাবে সিলিন্ডার রাখার কারণ জানতে চাইলে বাড়িটির কেয়ারটেকার নুরুল ইসলাম বলেন, নিরাপত্তার জন্য বাড়ির বেজমেন্টে সিলিন্ডার রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারের বিধিমালা রয়েছে। ফ্ল্যাটে গ্যাস সরবরাহের জন্য কোন ধরনের পাইপ ব্যবহার করা হবে তাও বিধিমালায় বলা হয়েছে। তরলকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বিধিমালা ২০০৪ (সংশোধিত ২০১৬)-তে বলা হয়েছে, ‘বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শকের লিখিত অনুমোদন ছাড়া এলপিজি পরিবহণের কোনো পাইপলাইন স্থাপন করা যাবে না। পাইপলাইন স্থাপনের পর নিয়মিতভাবে সব পাইপলাইন পরীক্ষা করতে হবে। সর্বোচ্চ কার্যকর চাপমাত্রায় পাইপের নিশ্ছিদ্রতা প্রমাণ করতে হবে। পাইপিং ব্যবস্থাকে সুরক্ষা করতে হবে।’ এই আইনে ঝুলন্ত পাইপ দিয়ে এলপিজি ব্যবহারের কোনো নিয়ম নেই। এতে স্থাপনার ঝুঁকি আরও বাড়ে। কারণ কোথাও ভবনের আগুন লাগলে এই পাইপগুলো পুড়ে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হতে থাকে, তখন আগুনের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) একেএম শাকিল নেওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, যারা এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নিতে হবে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরকে দায়িত্ব নিতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষিত লোক তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তর ভূমিকা রাখতে পারে। জনপ্রতিনিধিকেও এই কাজে লাগানো যেতে পারে। তিনি বলেন, যদি ঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে অবশ্যই সিলিন্ডার নিরাপদ। কিন্তু নিয়ম-কানুন না মানলে এটি মারণাস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। তিনি আরও বলেন, সিলিন্ডারের মুখের চাবির মান, গ্যাস সঞ্চালনের পাইপ এবং চুলা-সবকিছুরই একটি মাপকাঠি রয়েছে। সেটা সবাইকে অনুসরণ করতে হবে।

এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, আমরা সব সময় মানুষকে নিরাপত্তার বিষয়টি বলি। কিন্তু গ্রাহকরা তা মানছে না। একটি ভবনে কীভাবে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করবে, কী পাইপ ব্যবহার করবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন এলাকায় মডেল রয়েছে। কিন্তু ভবন মালিকরা তা মানছে না। এ বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, একটি সিলিন্ডারের আয়ু দশ বছর। এরপর সেটি পরীক্ষা করে ফিটনেস সনদ দেবে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। তারা তাদের কাজটি ঠিকমতো করছে কিনা তাও দেখা উচিত।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, আমাদের জনবল কম। এই জনবল দিয়ে সারা দেশে প্রতিটি এলাকায় গিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সচেতনতার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কাজ করছি। এ ব্যাপারে সবাই সচেতন হলে ঝুঁকির মাত্রা কমবে বলে তিনি জানান।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/791462