১ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১২:৪০

দেশে উদ্বৃত্ত উৎপাদন সত্ত্বেও পণ্য আমদানি কার স্বার্থে?

দেশে কিছু কিছু পণ্যের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হলেও এসব পণ্য দিব্যি বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এটি কার স্বার্থে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিদ্যমান একশ্রেণির সিন্ডিকেটকে আস্কারা দেয়ার ফলে এটি ঘটতে পারছে। এতে যেমন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটছে, এমনকি পাচারও হচ্ছে। তেমনই উদ্বৃত্ত পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকার একদিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলছে, পাশাপাশি আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য কৃচ্ছ্বসাধনের কথাও জোরেশোরে প্রচার করছে। একই সাথে এসব পণ্য আমদানিও অব্যাহত থাকছে-এটি স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড বলে তারা মনে করেন। দেশে পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, উদ্বৃত্ত ও আমদানির গত দুই বছরের গড় হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রধানত চাল, আলু, পিঁয়াজ, মাছ, ডিম প্রভৃতির ক্ষেত্রে এই অবস্থা বিরাজ করছে। এরকম আরো কি কি পণ্য চাহিদার বাইরেও আমদানি করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এভাবে পণ্য আমদানি করা কতোটা যৌক্তিক তাও তলিয়ে দেখা জরুরি বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

উৎপাদন বনাম আমদানি
বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিসংখ্যান ব্যুরো ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে চালের বার্ষিক গড় চাহিদা মোটামুটি ৩ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৪ কোটি ১৩ লাখ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত হয় ৫৩ লাখ মেট্রিক টন। চাল আমদানি করা হয় সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন। আলুর চাহিদা ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ১ কোটি ১১ লাখ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত হয় ২৬ লাখ মেট্রিক টন। আর আমদানি হয় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত হয় ১০ লাখ মেট্রিক টন। আর আমদানি হয় ৭ লাখ মেট্রিক টন। মাছের চাহিদা ৪৮ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত হয় ১ লাখ মেট্রিক টন। আমদানিও হয় ১ লাখ মেট্রিক টন। ডিমের চাহিদা ১ হাজার ৮০৬ কোটি পিস। উৎপাদন ২ হাজার ৩৩৮ কোটি পিস। আমদানি করা হয় ৫ কোটি পিস।

অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের মাধ্যম আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায়, সেবছর ৫১ কোটি ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের চাল আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত তাজা আলুর মূল্য পরিশোধ করা হয় ৪৩ লাখ ৯৫ হাজার মার্কিন ডলার। একই অর্থবছরে তাজা ও হিমায়িত মাছ আমদানি করা হয় প্রায় ২০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের।
চাল উৎপাদন ও আমদানি

সরকারি ভাষ্যমতে, গত বছর বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ কোটি ৭৭ লাখ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে চালের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ১৩ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগ বলছে, এভাবে ২০১৮ সাল থেকেই বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ চাল উৎপাদন হচ্ছে। তবে আমদানি করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা। বলা হচ্ছে, নানা কারণে চালের অপচয় হয়। ব্যক্তিগতভাবে অনেক কৃষক নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে চাল মওজুদ করেন, যেটি হিসাবেও নেই। ব্যবসায়ীদের কাছেও মওজুদ থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের হিউম্যান কনজাম্পশন (সরাসরি ভাত) ছাড়াও নন-হিউম্যান কনজাম্পশন (অন্যান্য কাজে) আছে। হিউম্যান কনজাম্পশন হিসাবে উদ্বৃত্ত ঠিকই আছে। তবে নন-হিউম্যান কনজাম্পশনও বাড়ছে। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চাল নন-হিউম্যান কনজাম্পশনে ব্যয় হয়ে যায়। ঝুঁকি মোকাবিলা ও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার চাল আমদানি করে থাকে।
আলুর অবস্থান

আলুর আমদানি নিয়েও প্রশ্ন আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৮৫ লাখ টন। তাদের হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থ-বছরে দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ টন। অর্থাৎ বার্ষিক চাহিদার চেয়েও উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ টন বেশি। গত বছর নভেম্বরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, সরকার দু’দিনে ৪৯ হাজার ৭৫৫ টন আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছে। ৭৭টি আবেদনের বিপরীতে এই অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এই আমদানি শুরুর পর থেকে পাইকারি বাজারে আলুর দাম কমার খবর আসতে থাকে। ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানিটা নিয়মিত হলে স্বাভাবিক হয়ে আসবে আলুর দাম। দেখা যাচ্ছে, কেবল ‘বাজার নিয়ন্ত্রণ’ নামক কৌশল ব্যবহার করেই এই আমদানির পথ খুলে রাখা হয়েছে।

পেঁয়াজ আমদানি কেনো?
সূূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৬ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থ-বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ৩৬ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার বেশি উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টন। দাবি করা হয়, চীন ও ভারতের পর শুধু বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশই নয়, আমদানিতেও শীর্ষে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, ঘাটতি নয়, বরং বাড়তি উৎপাদন হচ্ছে পেঁয়াজ। এমন তথ্য খোদ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের। তারপরও পেঁয়াজ আমদানি না করলে সারা বছরই অস্থির থাকছে পেঁয়াজের বাজার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। আর আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। অর্থাৎ, সরকারি হিসেবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি অন্তত ৪ লাখ থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু তারপরও শুধুমাত্র ভারত থেকেই চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে ৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। কাজেই, প্রশ্ন ওঠেছে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কেনো আমদানি ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

অহেতুক মাছ আমদানি
দেশে মাছ আমদানিকেও ‘অহেতুক’ মনে করা হচ্ছে। মাছ উৎপাদন ও আহরণকারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর দেশের জেলেরা মাছ রপ্তানির সক্ষমতা তৈরি করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার ২১১ টন মাছ ও চিংড়ি উৎপাদন করেছে। এর মধ্যে ৭৩ হাজার ১৭১ টন মাছ ও চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। মৎস্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পরও সামুদ্রিক এমনকি মিঠা পানির মাছ আমদানি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মৎস ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, এ ধরনের সামুদ্রিক মাছ আমদানির জন্য শুধু ফরমালিন পরীক্ষার বিধান থাকায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাছ নামমাত্র মূল্যে আমদানি করছেন। মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নামমাত্র দামে নি¤œমানের মাছ আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে সামুদ্রিক মাছ আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে স্থানীয় সামুদ্রিক মাছ আহরণকারী, ট্রলার ও অন্যান্য মাছ উৎপাদকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। মাছ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করার পরও বছরে প্রায় ৪ কোটি ডলারের সামুদ্রিক মাছ আমদানি হচ্ছে। সরকার যখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ঠিক রাখতে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছে, তখন সামুদ্রিক মাছ আমদানি কমিয়ে আনার দাবিও উঠছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মাছ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, বাংলাদেশকে বিশে^র অষ্টম শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। বাংলাদেশ নদী ও সমুদ্রে মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে পঞ্চম এবং সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনে ১২তম। এ কারণে মাছ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি করে আসছেন তারা।

ডিমের বিপুল উৎপাদন
আমিষের অন্যতম যোগানদাতা হিসেবে রয়েছে ডিম। যথেষ্ট উৎপাদন সত্ত্বেও এটি আমদানি পণ্য থেকে বাদ যায়নি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ডিমের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৬ কোটি পিস। আর ডিমের উৎপাদন ছিল ২ হাজার ৩৩৮ কোটি পিস। চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ২ হাজার ৭১১ কোটি পিস, যা বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয় ২ হাজার ৩৩৮ কোটি পিস। কিন্তু এই ডিমের বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতেও আমদানি করতে হচ্ছে। এবার তৃতীয় দফায় আরো ৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালায়। ‘বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায়’ বাজারে ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বাজারদর স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২৪ এর শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে পাঁচটি কোম্পানিকে এক কোটি করে মোট পাঁচ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়ার কথা জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সরকারের বাধ্যবাধকতা?
চাল চাড়াও ডিম, আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্য উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পরেও ‘বাজার নিয়ন্ত্রণ’ করতে এসব পণ্য আমদানি করতে ‘বাধ্য’ হচ্ছে সরকার। যদিও উৎপাদনকারীদের দাবি, আমদানির দিকে মনোযোগ না দিয়ে সরকারের সিন্ডিকেট ভাঙা উচিত। এর সঙ্গে একমত কৃষি অর্থনীতিবিদেরাও। তাদের মতে, আড়তের নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে আমদানির প্রয়োজন হবে না। সিন্ডিকেট উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাই দাম বাড়ছে। তাছাড়া দাম বাড়ার আর কোনো কারণ নাই। দীর্ঘ মেয়াদী উৎপাদন বাড়ানো এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করাÑএটি মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যখন ফসল নষ্ট হয়ে যায়, তখন বাধ্য হয়ে আমদানি করতে হয়। সেসব ক্ষেত্র ছাড়া আমদানি করার জরুরি নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার নিত্যপণ্যের মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। ফলে আমদানিও বন্ধ করা যাচ্ছে না। এতে একদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা খোয়া যাচ্ছে, অপরদিকে সরকারের সিন্ডিকেট ভাঙার অক্ষমতাও প্রকাশ পাচ্ছে।

https://www.dailysangram.info/post/552814