১ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ১২:২৯

অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তের বিবেচনা

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

এই মুহূর্তে বিষয়টি যতই করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সাম্প্রতিক ইসরাইল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ এবং দেশের অভ্যন্তরে নির্বাচন নিয়ে গোলযোগ বিশৃঙ্খলার পরিবেশ পরিস্থিতি উদ্ভূত বলে প্রচার পাক না কেন, বাংলাদেশের মতো অতি সম্ভাবনাময় উন্নয়নশীল অর্থনীতি দুর্বল থেকে দুর্বলতরো হওয়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন কারণে করোনার আগে থেকেই। এই মুহূর্তে যা দৃশ্যমান হচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হয়, ভবিষ্যতের রাজনীতি অর্থনীতিকে আরো অনিশ্চিত করে তুলবে। অর্থনীতির অধোগতি এখনই সামাল দেয়া যাচ্ছে না। একটি অর্থনীতি সুস্থ সবল ও গতিশীল থাকার জন্য বিভিন্ন সূচকের ব্যারোমিটার যেভাবে ওঠানামা করছে তা ক্রমেই হিমাংকের দিকেই চলে যাচ্ছে। এনবিআর (রাজস্ব আহরণ), বাংলাদেশ ব্যাংক (অর্থবাজার তথা ব্যাংকিং সেক্টর), সিকিউরিটিস এক্সচেঞ্জ কমিশন (পুঁজিবাজার), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের (দ্রব্যমূল্য তদারকি) মতো নিয়ন্ত্রক ও পোশক প্রতিষ্ঠানসমূহ ইদানীং তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে গেলেও কেন জানি বল ও ব্যাটের সমন্বয় হচ্ছে না, অর্থনীতির অস্থিরতায় অর্থবহ উন্নয়ন স্বব্যাখ্যাত ও স্বীকৃত হতে পারছে না। উন্নয়ন ভাবনায় স্বার্থবাদী লুটেরা উপাদানের বাহুল্যতায়, বল্গাহীন দুর্নীতির অনুপ্রবেশে, জাতীয় চেতনাকে দলীয় চিন্তা ও স্বার্থবাদিতার নিগড়ে নিক্ষেপের কারণে ‘যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন কেষ্ট বেটাই চোর’ ধরনের আস্থাহীন পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগ ওঠার সুযোগ মিলছে। উন্নয়নকে মন্দ বিনিয়োগ সাব্যস্ত হওয়ায় বা করায় তাতে অর্থনীতিতে যে সক্ষমতা গড়ে ওঠার কথা তার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। আয় বৈষম্য বৃদ্ধি এখন সবখানে বুমেরাং হিসেবে ফিরছে। কিছু দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সুদান, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হোক, কোনো দেশই সেটি চায় না। এসব দেশে স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিবাদী চেহারা উন্মোচিত হতে অনুঘটকের কাজ করেছে সুশাসনের অভাব, জবাবদিহির দৈন্যতা এবং সর্বত্রগামী দুর্নীতি এখানকার এবং এখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি উন্নয়নকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সেখানে এখানে দুর্নীতিই এখন দুর্নীতির উৎস হিসেবে সাব্যস্ত হচ্ছে। এ দুর্নীতি শুধু আর্থিক লেনদেনের সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ নেই, দুর্নীতি এখন ইতিহাস বিকৃতিতে, মুক্তবুদ্ধি, মতপ্রকাশে বাধাদানে, চিন্তাচেতনায় বিভক্তিকরণে, মৌলিক অধিকার হরণে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয় তথা রাজনীতিকীকরণে, রাজনৈতিক উৎকোচের মাধ্যমে কোটারি পোষণ তোষণেও পরিব্যাপ্ত।

এই মুহূর্তে এটি বিবেচনায় আনতে, মানতে ও স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশ ৫২ বছরে নানা রকম বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মোটামুটি একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নটা, বিশেষ করে প্রবৃদ্ধি, গ্রোথ, সেটিই বেশি প্রতীয়মান এখন। বাকি যে সার্বিক উন্নয়ন, তা লাগসই ও টেকসই হওয়া সম্পর্কে এখনো অনেক প্রশ্ন আছে। এটা এমন নয় যে, এক বা দুই দশকের মধ্যে এগুলো অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। গত পাঁচ দশকে কখনো কম অর্জন, কখনো বেশি অর্জন এভাবে বাংলাদেশ এই পর্যায়ে পোঁছিয়েছে। এখন বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া। দেশ ও অর্থনীতি স্থায়ী, টেকসই উন্নয়নের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটা কিন্তু এখনো বলা যাবে না।

এমতাবস্থায় যদি দেশ ও অর্থনীতির অবস্থা অস্থিতিশীল হয়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি ধারাবাহিকভাবে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি দেয় বা দিতে বাধ্য হয়, তবে দেশের অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হবে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি প্রকারান্তরে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যক্রমে বিগত বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের আগে একই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারের এবং বিরোধীদের মনোযোগটা বেশি বিচ্যুত হয়েছে। ২০০৬, ২০১৩, ২০১৮ এবং এবারো রাজনীতির দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে অর্থনীতি ঠিক করার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন সেদিকে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মনোযোগ মর্মযাতনায় পরিণত হয়েছে।

এটি সর্বজনবিদিত যে, রাজনৈতিক সঙ্ঘাত এবং সহিংসতায় সম্পদের ক্ষতি হয়, মানুষের ব্যবসায়-বাণিজ্য বিনিয়োগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, পণ্য সরবরাহ এবং ব্যক্তি ও সামষ্টিক আয় ও ব্যয় ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি শেষমেশ সামাজিক সংহতি এবং অর্র্থনীতির সহনশীল শক্তিকে বিনষ্ট করে। ক্ষমতায়নে অন্তর্ভুক্তির চেতনা কার্যকর না থাকলে, জনগণকে বাদ দিয়ে, উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে, বিচ্যুত করে ‘আমরাই সব দখল করব’, সেটি সঠিক নীতি নয়। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে নিবর্তনমূলক আইন না পড়ে পাস করার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা থেকেই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেই আইন প্রয়োগযোগ্যতারও প্রশ্ন ওঠে। সব নাগরিকের সমঅধিকার বণ্টনের বিষয় রয়েছে, সবাইকে সমান অধিকার ও অবস্থান স্বীকার করাও সাংবিধানিক দায়িত্ব। বল প্রয়োগ করে টিকে থাকাটা অসাংবিধানিক।

এই মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য বড় বিবেচ্য বিষয় হলো কোনো অবস্থাতেই সঙ্ঘাত যাতে দীর্ঘ না হয়, সে চেষ্টা চালাতে হবে। সঙ্ঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সব কিছুর সমাধান সবার কাম্য। দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতি খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, এখন নির্বাচনের নামে যা শুরু হয়েছে, তা চলতে থাকলে অর্থনীতি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনীতি খারাপ হলে সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। হরতাল-অবরোধ ও সঙ্ঘাতের কারণে ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হলে সেখানে বেতন-ভাতা দেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলা ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে। সব মিলে সমঝোতার রাস্তা তৈরি না হলে সামনের সময় আরো খারাপ হবে। এখানে সব পক্ষকে উদ্যোগী ভূমিকায় দেখা না গেলে অর্থনীতিকে চরম মাশুল দিতে হবে, যার থেকে উত্তরণে দেশকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

বিজ্ঞজনের অভিমত, রাজনৈতিক সঙ্ঘাত একটি দেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যেখান থেকে বের হয়ে আসার সহজ কোনো উপায় থাকে না। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সব পক্ষেরই একটি সমঝোতায় আসার বিকল্প নেই। সব রাজনৈতিক বিরোধকে রাজনৈতিক পন্থায় শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা। দু’পক্ষই বলছে, রাজপথে মোকাবেলা হবে। এটি কোনো কার্যকর সমাধান এনে দেবে না। সমাধান হতে হয় সংলাপে, সেখানে দেয়া-নেয়ার ব্যাপার আছে, স্বচ্ছতার ব্যাপার আছে, আছে পারস্পরিক অধিকারের ব্যাপার। এ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করার চিন্তা করা সমীচীন হবে না। মানতে হবে রাজনীতি যদি স্থিতিশীল না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটবে না। রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল কোনো দেশে স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ হবে না। বিদেশে বড় বড় রোড শো করে বিদেশী বিনিয়োগ আনা যাবে না, তারা আসবে না। তাদের কাছে এ দেশের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর আছে। সমঝোতার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা আনা বা আসা ছাড়া কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা যাবে না এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ততা ঠেকানো যাবে না।

মনে হবে সরকারের সব মনোযোগ যখন রাজনীতির দিকে, যখন গণমানুষের প্রতি তাদের নজর থাকে না, তখন অসহায় মানুষ প্রতিকার দাবিতে দাঁড়ানোর জায়গাও পায় না। মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে অনেক কষ্টে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়ছে না; বরং আরো সঙ্কুচিত হচ্ছে। সবাই দেখছে বন্দরে জাহাজ কম, পণ্যবাহী ট্রাকের পরিমাণ কম, কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা আগে থেকেই ছিল। ইদানীং এটি কোন দিকে যাবে সেটি ভাবতেও সবার মধ্যে ভয় ঢুকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামগ্রিক সঙ্কটকে কতখানি নিচে নামিয়ে দিতে পারে, তা নিয়ে সবাই শঙ্কিত।

দেশ সমাজ ও রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও আস্থার জায়গা না থাকলে এবং আলোচনা-সমঝোতার সুযোগ ব্যর্থ হলেই অস্থির পরিস্থিতির অবতারণা হয়। রাজনৈতিক চর্চা যে মূল্যবোধের ভিত্তিতে করতে হয়, সেখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই। একটি দল ক্ষমতায় থাকবে, আরেকটি দল বিরোধী অবস্থানে থাকবে। সবার রাজনৈতিক চর্চাই হবে দেশের স্বার্থে কাজ করা। এটি ভুলে গেলেই দেশকে কিছু দিন পরপর একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য নিপতিত হতে হয়, যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।

এই মুহূর্তে এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, দিন দিন আর্থিক বৈষম্য বেড়েই চলছে। আর্থিক বৈষম্য মানে আয়ের বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য। এই যে আর্থিক বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য সাধারণ মানুষের বা যেকোনো মানুষের জীবনের ওপর নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব ফেলছে। কারণ আয়ের সংস্থান যদি না থাকে এবং আয়ের বৈষম্য থাকে, তাহলে যতই সার্বিকভাবে সামষ্টিক উন্নতি হোক, বিষয়টির ফল কিন্তু সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে না। এখন জানতে হবে এর কারণ কী? মুখ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. নীতির দুর্বলতা; ২. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব; ৩. দুর্বল প্রতিষ্ঠান; ৪. রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবযুক্ত অদক্ষ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও ৫. সব জায়গায় সুশাসন অর্থাৎ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। সরকারি খাতে নানারকম সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন, প্রশাসনসহ অন্যান্য ব্যাপারেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির যথেষ্ট অভাব আছে। অপরদিকে প্রাইভেট সেক্টরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিন্তু খুব ভালোভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় নেই। এর প্রতিফলন দেখা যায় বাজার অনিয়ন্ত্রিত। মূল্যস্ফীতি ঘটছে। লোকজনের আয়ের সংস্থান কমে যাচ্ছে দিন দিন। লোকজনের যে নানা রকম সমস্যা, সেগুলোর কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। এমন নয় যে, সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ কেউ জানে না। এখানে সদিচ্ছা, সচেতনতা ও সততার অভাব রয়েছে। চটজলদি এগুলো দূর করা যাবে না, তবে শুরু করতে হবে এই মুহূর্ত থেকে যদি আমরা অর্থনীতিকে প্রকৃত উন্নয়ন অভিমুখী করতে চাই।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/825568