২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:২০

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পদক্ষেপ চায় জাতিসংঘ

রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ লাঘবে এখনই পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। সম্প্রতি ঢাকা সফরকারী মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার (দূত) ইয়াংহি লি গতকাল জেনেভায় দেয়া এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর সদ্যসমাপ্ত সাঁড়াশি অভিযানকালে বহু লোককে গলা কেটে হত্যাসহ বর্বর নির্যাতন, বাছ-বিচারহীন গুলি, ঘরের ভিতরে লোকজনকে (নারী-পুরুষ শিশু) আটকে রেখে অগ্নিসংযোগ ও পুড়িয়ে হত্যা, কম বয়সী শিশুকে (জীবন্ত অবস্থায়) আগুনে নিক্ষেপ, রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণ এবং তাদের সঙ্গে অন্য যৌন নির্যাতনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে বর্মী বাহিনীর বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ বরাবরই এ নিয়ে সোচ্চার রয়েছে। উত্থাপিত অভিযোগগুলো তদন্তেও সরব রয়েছে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংবেদনশীল রাষ্ট্র, জোট ও সংস্থা-সংগঠনগুলো।

বিবৃতিতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, সেখানে (রাখাইনে) এরই মধ্যে যেসব ঘটনা ঘটেছে, যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার স্বচ্ছ-স্বাধীন, পক্ষপাতহীন ও  দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করতে আমি মিয়ানমার সরকারের প্রতি (ফের) আহ্বান জানাচ্ছি। সেখানে যেন পরবর্তীতে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের আর কোনো ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থাও কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। একই সঙ্গে ওই (রোহিঙ্গা) সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত যেসব বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা নিরসনে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মাঝে আশা জাগাতে হবে। সেটা আমাদের দায়িত্ব। তাদের প্রতি যে বর্বর আচরণ করা হয়েছে, তার যে তদন্ত হবে সেটি নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ঘটনার শিকার (সরাসরি নির্যাতিত বা নির্যাতনের সাক্ষী) রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং সেসব পরিবার, যাদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, এটি তাদের প্রাপ্য। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্মী বাহিনীর বর্বর নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরজমিন দেখতে গত ১৯-২৩শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও কক্সবাজার সফর করেন জাতিসংঘে মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক ওই বিশেষ দূত।

এর আগে (গত মাসে) তিনি মিয়ানমার সফর করেন। সেখানে প্রায় ১২ দিন কাটান তিনি। ঢাকা সফরকালে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে মতবিনিময় করেন তিনি। নির্যাতনের কারণে রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারে অস্থায়ী আশ্রয় নেয়া (নবাগত) রোহিঙ্গা মুসলিম নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সঙ্গে তিন দফা তার কথা হয়। এখানে আসার আগে তাদের ওপর বর্মী বাহিনী যে বর্বরতা চালিয়েছে সেটির বর্ণনা সরাসরি নির্যাতিত এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখ থেকেই শোনেন। চার দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে চলতি সপ্তাহের শুরুতে জেনেভায় ফিরেন তিনি। সেখানে পৌঁছার পর পর এই প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রচার করা হয় তার দপ্তর থেকে। সেই বিবৃতিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি জাতিসংঘ দূতের আহ্বান এবং তার বাংলাদেশ সফর, বিশেষত কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের অভিজ্ঞতার খানিকটা স্থান পেয়েছে।

বিবৃতিতে জাতিসংঘ দূত বলেন, যারা পরিস্থিতির শিকার এবং সাক্ষী সেই (রাখাইনে বর্বরতার শিকার) পরিবারগুলোর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাদের ওপর চালানো সহিংতার ভয়াবহ এক চিত্র আমি পেয়েছি, যা আমার প্রাথমিক ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত। জাতিসংঘের ওই স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার আগামী ১৩ই মার্চ এ নিয়ে সংস্থার মানবাধিকার কাউন্সিলে বিস্তারিত রিপোর্ট উপস্থাপন করবেন। রিপোর্টটি অনলাইনেও একই সঙ্গে প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান মতে, গত বছর ৯ই অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন, নির্বিচারে লোকজনকে হত্যা, ধর্ষণের পাশাপাশি তাদের ঘরবাড়ি পোড়ানো ও সহিংসতা ছড়িয়েছে বর্মী বাহিনী। এর ফলে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

এখানে আগে থেকে প্রায় ৩২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং প্রায় আড়াই লাখ অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক রয়েছে। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়া হলেও জনবহুল বাংলাদেশের ওপর এটি বাড়তি চাপ। তাছাড়া পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রোহিঙ্গারা নানা অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার তাদের স্বেচ্ছায় নিজ বসতভিটায় ফেরানোর জন্য মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের সঙ্গে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আন্তর্র্জাতিক এবং আঞ্চলিকভাবেও দেশটির ওপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ঢাকা। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর আগ পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচরে অস্থায়ী পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাশে চায় বাংলাদেশ।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=55465