২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১:০৫

সরকারের কেনা নিষিদ্ধ ওষুধের কী হবে?

উচ্চ আদালত গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০ কম্পানির সব ধরনের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ ও ১৪টি কম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক আইটেমের ওষুধের লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন। তার ১৩ দিনের মাথায় এবার গতকাল সোমবার ২৮ কম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিক্যান্সার, স্টেরয়েড ও হরমোনজাতীয় ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দিলেন আদালত। যদিও সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, উচ্চ আদালতের নির্দেশের আগেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে কালো তালিকাভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে কোনো কোনো কম্পানি কারসাজির মাধ্যমে অ্যান্টিক্যান্সার ও হরমোনজাতীয় ওষুধ চালু রেখেছে। এমনকি এক বছর ধরে এমন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ওই তালিকাভুক্ত একটি কম্পানির হরমোনজাতীয় একটি ওষুধের ৪৬ লাখ ভায়াল ইনজেকশন কিনেছে সরকারেরই পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। দাম পড়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। এগুলো তারা নিয়েছে সারা দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য। এ

নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক আছে। গতকাল উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর এখন এই বিপুল পরিমাণ সরকারি ওষুধের পরিণতি নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা উচ্চ আদালতের নির্দেশের আগেই তালিকাভুক্ত সব কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। তার পরও যদি কোনো কম্পানি নির্দেশ অমান্য করে থাকে তবে উচ্চ আদালতের আদেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ওই কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আদালত যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, সবই পালন করা হবে। ’

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় ৮৪টি ওষুধ কম্পানির বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি নির্দেশিকা অনুসরণ না করে ওষুধ উৎপাদন করাসহ অন্যান্য অনিয়মের দায়ে ওই প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে ২০টি ওষুধ কম্পানি বন্ধ করে দেওয়া, ১৪টি ওষুধ কম্পানির শুধু অ্যান্টিবায়োটিক আইটেমের ওষুধের লাইসেন্স বাতিল, ২২ কম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন গ্রুপের ওষুধের লাইসেন্স বাতিল এবং একটি কম্পানির তিন ইউনিটের পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিক্যান্সার ও হরমোনজাতীয় ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করে। পরে পর্যায়ক্রমে ওই সুপারিশের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের আদেশ এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনা অনুসারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রথমে ২০টি কম্পানির মূল লাইসেন্স এবং ১৪টি কম্পানির অ্যান্টিবায়োটিকজাতীয় ওষুধের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ সংসদীয় কমিটির একই সুপারিশের আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর আলাদা করে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি ইউনিটের পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি ক্যান্সার ও হরমোন-জাতীয় ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করে দেয়। আর এ কম্পানি নিয়েই বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।

গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরও এ ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে জুনে টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের হরমোন-জাতীয় একটি ওষুধের ৪৬ লাখ ভায়াল ইনজেকশন কিনেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এ ওষুধের দাম পড়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। এর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তবে অভিযুক্ত কম্পানির নানামুখী তত্পরতায় বিষয়টি চাপা পড়ে যায় এবং ওই ওষুধই বিতরণ করা হয়, এখন যা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক এলিয়াছ মান্নান ওই ওষুধ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্তের কথা স্বীকার করে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন আমরা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকব। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই হবে। ’ তিনি বলেন, ‘সম্ভবত নিষেধাজ্ঞার আগেই ওষুধগুলো কেনা হয়েছিল। ’

তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর টেকনো ড্রাগসের পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি ক্যান্সার ও হরমোন-জাতীয় ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করলেও ওই আদেশে এর ভিত্তি বা কারণ দেখানো হয়েছে সংসদীয় কমিটির সুপারিশকে। তাই কার্যত যেদিন সংসদীয় কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ওই সুপারিশকে তাদের সিদ্ধান্ত বলে গ্রহণ করেছে, সেদিন থেকেই এটি কার্যকর হয়েছে। তাই ওই সুপারিশে বাতিলের আওতায় থাকা সব আইটেমের ওষুধই ওই সময় থেকেই বাতিল বলে ধরা হবে। সুপারিশে এসব ওষুধকে পরিষ্কারভাবেই নিম্নমানের প্রক্রিয়ায় তৈরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওই প্রশ্নবিদ্ধ ওষুধ কেনা এবং তা মানুষের ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করা ঠিক হয়নি। বরং এই ওষুধ ব্যবহার এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

তবে এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া এসব ওষুধের কী হবে কিংবা এ ওষুধ ব্যবহারে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর দায়ভার কে নেবে—এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক এলিয়াছ মান্নান বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। ’

যেসব ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলোর নাম প্রকাশ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের খ্যাতিমান একজন চিকিৎসক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি ক্যান্সার, হরমোন-জাতীয় ওষুধগুলো খুব স্পর্শকাতর। অ্যান্টি ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি মারাত্মক। মানুষের জীবন সুরক্ষায় এসব ওষুধ খুবই সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। তাই এ ধরনের ওষুধের মানগত কোনো সংশয় থাকা চলে না। যেসব কম্পানির এজাতীয় ওষুধ সংসদীয় কমিটি কর্তৃক মনোনীত বিশেষজ্ঞরা নিম্নমানের বলে প্রমাণ পেয়েছেন, সেসব কম্পানির ওষুধ রাজধানীর বড় বড় ফার্মেসিতে খুব একটা না থাকলেও মফস্বল এলাকার ফার্মেসিতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। তাই সংসদসীয় কমিটির সুপারিশের বিষয়টি প্রকাশের পর থেকে সারা দেশের চিকিৎসকদের মধ্যেই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। আবার যেসব চিকিৎসক বা রোগী এ বিষয়টি জানতে পারেনি, তারাও তো না জেনেই ওই ওষুধ ব্যবহার করে যাচ্ছে; যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মারাত্মক অনৈতিক অবস্থান। এ ছাড়া নিয়ম থাকলেও ঔষধ প্রশাসন কেন নিষিদ্ধ ঘোষিত ওষুধের নাম জনসক্ষে প্রকাশ করছে না, সেটা সরকারের দেখা উচিত। উচ্চ আদালতের আদেশের পর অবশ্যই দ্রুত সময়ের মধ্যে সব নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকা বিধি অনুসারে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। ’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাদের পরিদর্শকরা সব সময়ই মাঠে থাকেন। তাঁরা খুঁজে দেখেন নিষিদ্ধ কোনো ওষুধ কোথাও আছে কি না। পেলেই সেগুলো জব্দ করা হয়। আর নাম প্রকাশের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতেই হবে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/02/28/468770