২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:৪৬

ঢাকা ওয়াসার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প

পদে পদে ভয়াবহ দুর্নীতি

আইএমইডির প্রতিবেদন : দরপত্র ছাড়াই ঠিকাদার নিয়োগ * ৮০ ঠিকাদারকে অতিরিক্ত বিল প্রদান * ১১টির স্থলে দুই শতাধিক প্যাকেজে কাজ সম্পন্ন

রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে ঢাকা ওয়াসার এক প্রকল্পে পদে পদে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে খোদ সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ঠিকাদারকে অতিরিক্ত বিল দেয়া, দরপত্র ছাড়াই ঠিকাদার নিয়োগ, সড়ক পুনর্নির্মাণ খাতে বরাদ্দ অর্থের সঠিক ব্যবহার না করা, নিন্মমানের কাজ এবং সমন্বয়হীনতায় আর্থিক অপচয়সহ নানা অনিয়মের চিত্র ওঠে এসেছে সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে। এমনকি পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিতে অনুমোদিত ১১টির স্থলে দু’শতাধিক প্যাকেজে দেয়া হয়েছে প্রকল্পের কাজ।

শুধু তাই নয়, বেশ কিছু কাজ অসম্পন্ন রেখেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে প্রকল্পের সমাপ্তি। এতে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূর করে নগরবাসীর জন্য পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত এবং টেকসই আবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি বলে মন্তব্য করা হয় ওই প্রতিবেদনে। এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে আইএমইডি।

তবে, উল্লিখিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তাকসিম এ খান। তিনি শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘এ প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আমরা আইএমইডির প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা ইতিমধ্যে দিয়েছি। যদি দুর্নীতির কোনো তথ্য প্রমাণিত হয় তাহলে আমরা কঠোর হস্তে ব্যবস্থা নেব। তবে এটুকু বলতে পারি পলিসির বাইরে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের পলিসি একটাই, তা হল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করা। এ জন্যই বড় বড় ঋণদাতা বিদেশী সংস্থাগুলোর অর্থায়নে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। দুর্নীতি হলে বিদেশী সংস্থার এত টাকা ল্যান্ডিং হচ্ছে কিভাবে। এ থেকেও বোঝা যায় আমরা দুর্নীতি করছি না।’

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ২০ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি ছোট বা বড় বলে কোনো কথা নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল বা সুবিধা অর্জন করেছে, তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১০ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০১৪ সালের জুনে শেষ হয় ‘ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (ফেজ-২)’ শীর্ষক প্রকল্পটি। যদিও প্রকল্প সমাপ্তির নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ২ বছর। কিন্তু সেটি না হওয়ায় পরে আরও ২ বছর বাড়ানো হয়েছিল। প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৯৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১৬৯ কোটি ২৮ লাখ ১৯ হাজার টাকা। প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণার সময় বাস্তবায়ন অগ্রগতি ছিল ৮৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

আরও জানা গেছে, রাজধানীতে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বাস। কিছু দিন আগেও ৬৩টি খাল দিয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতো। তাছাড়া পুকুর ও জলাশয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষিত হতো। কিন্তু বর্তমানে নগরায়নের ফলে অপরিকল্পিত পুকুর ও জলাশয় ভরাট এবং খাল-নদী দখল হওয়ায় নগরীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কারণ ছাড়াই মোটা অঙ্কের অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছে। পণ্য সংগ্রহে ৪টি এবং পূর্ত কাজ ৭টি অর্থাৎ মোট ১১টি প্যাকেজে কাজ সম্পন্ন করার অনুমোদন থাকলেও তা দু’শতাধিক প্যাকেজে করা হয়। এরমধ্যে ৮০টি ঠিকারদার প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিবহির্ভূত অতিরিক্ত অর্থ পরশোধ করা হয়েছে। এসব প্যাকেজের আওতায় বেশির ভাগ ঠিকাদারের কার্যাদেশের তারিখ থেকে কাজ শেষ করার সময় গড়ে ৩-৬ মাস ছিল। তাই এ সময়ের মধ্যে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি এসব ছোট প্যাকেজে নির্ধারিত কাজের বাইরে কাজ বাড়ানো অথবা অপ্রত্যাশিত অঙ্গ যুক্ত করার কোনো সুযোগ ছিল না বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। এতে অতিরিক্ত বিল দেয়া ৮০টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নামসহ বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মিয়া অ্যান্ড মিয়া বিল্ডার্সকে ৪৭ লাখ ২১ হাজার টাকার কাজ দেয়া হয়েছে ৫৩ লাখ ২৮ হাজার টাকায়, মোল্লা ট্রেড অ্যান্ড কমার্সকে ৪৭ লাখ ২১ হাজার টাকার স্থলে ৫২ লাখ ৯৪ হাজার, ইউনিক এন্টারপ্রাইজকে ৪৭ লাখ ২১ হাজার টাকার স্থলে ৫৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা, মক্কা ট্রেডার্সকে ২১ লাখ ৯৬ হাজার টাকার স্থলে ২৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা এবং এইইচএ কনস্ট্রাকশনকে ৭৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার স্থলে দেয়া হয়েছে ৮৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি বা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) উম্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় কার্যক্রমের সংস্থান থাকলেও সেটি মানা হয়নি। এক্ষেত্রে বেশ কিছু ক্রয় কার্যক্রম ছোট ছোট লটে বিভক্ত করে সংস্থার রুটিন কাজের আদলে সরাসরি ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। এটি আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃংখলার পরিপন্থী। এসব ক্রয় কার্যক্রমের কয়েকটি হচ্ছে- মিরপুর কাজীপাড়া এলাকায় রোকেয়া সরণিতে ক্যাচপিট নির্মাণ, ধানমণ্ডি ২নং রোডে ৬০০ মিমি ব্যাসের স্টর্ম স্যুয়ার লাইন, আগারগাঁও গ্রামীণ ব্যাংক রোডে ম্যানহোল উঁচুকরণ, পল্লবী এলাকায় দুয়ারীপাড়া খাল পুনঃখনন, সবুজবাগ মান্ডা মেইন রোড এলাকায় ক্যাচপিট তৈরি, হাজারীবাগ খালে ইউ চ্যানেল নির্মাণের জন্য সিকদার মেডিকেল কলেজ অংশ ও কালু নগর অংশে সাব-সয়েল ইনভেস্টিগেশন।

নিন্মমানের কাজ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিদর্শনকালে দেখা যায় মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকায় নির্মিত সড়ক ক্রসিংয়ে আরসিসি বক্স কালভার্টের নির্মাণ কাজ নিন্মমানের হয়েছে। আরসিসি বক্স কালভার্টের স্লাবের রড বের হওয়া এবং সঠিক অনুপাতে কাস্টিং করা হয়নি। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় পুনঃখননকৃত খালে আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ও স্থাপন যথাযথ হয়নি। ফলে খালের ধারে কোথাও কোথাও ওয়াল বাঁকা হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাবে মানসম্মত নির্মাণ কাজ হয়নি।

এ ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ওয়াসার মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। এ কারণে বিপুল অংকের অর্থের অপচয় হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

কাজ অসমাপ্ত থাকার বিষয়ে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী ৭৫০ মিমি থেকে ১৮৩০ মিমি ব্যাসের ৫৬ কিলোমিটার পাইপ ক্রয় বাবদ ৪০ কোটি টাকার সংস্থান ছিল। কিন্তু ৩৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫১ কিমি পাইপ কেনা হয়েছে। আবার একই ব্যাসের পাইপ ড্রেন স্থাপনের জন্য ৫৪ কিলোমিটার ক্রয় বাবদ ৬৯ কোটি ২৮ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। কিন্তু ৫৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪৮ কিলোমিটার পাইপ ড্রেন স্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ অনুমোদিত সংস্থান থেকে কম পাইপ ক্রয় ও স্থাপন করা হয়েছে। আবার ডিপিপিতে এক হেক্টর জমি অধিগ্রহণ বাবদ ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও ২ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে মাত্র শূন দশমিক ৩৪ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ঢাকা ওয়াসার পাইপ ও ড্রেন স্থাপনের সময় সিটি কর্পোরেশনের ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ বাবদ চাহিদা অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনকে ২৬ কোটি ৯৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন মানসম্মত কাজ করেনি। ফলে অর্থ ব্যয় হলেও ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ব্যবহার করে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/02/28/104777