২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:১০

বিশ্বজিৎ থেকে লিটন হত্যা : মিথ্যাচারের দীর্ঘ কাহিনী

দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ হোক

* জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার নিরপরাধ ১৫৫ জনের সহসাই মুক্তি মিলছে না

* সব তথ্য মিলেছে দুই সপ্তাহ’র মধ্যেই চার্জশিট : রংপুরের ডিআইজি

* এক সমন্বয়ক পলাতক আরেকজন নজরদারিতে : বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক গ্রেফতার

* নব্য জেএমবির নামে মন্দিরে হামলা করিয়েছিলেন কাদের খাঁন : দাবি পুলিশের

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : গাইবান্ধার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) মনজুরুল ইসলাম (লিটন) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকার ও রাষ্ট্রের সর্ব পর্যায় থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর দায় চাপানোর যে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল তা ভ-ুল হয়ে গেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে পুলিশের সঠিক পদক্ষেপ ও তদন্তের কারণে। পুলিশী তদন্তের গতি রাজনৈতিক ঢামাডোলে তলিয়ে না গিয়ে সেটি সঠিক পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ায় আজ দোষারোপের রাজনীতি হয়েছে “বুমেরাং”। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শরীক দল জাতীয় পার্টিরই একজন সাবেক এমপি (সাবেক সেনা কর্মকর্তা ডা.আব্দুল কাদের খান) লিটন হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি উদঘাটন করেছে ‘পুলিশ’।

এদিকে ওই হত্যাকাণ্ডের পরপর সন্দেহভাজন হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের যে ১৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাঁদের সহসাই মুক্তি মিলছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই হত্যার পরিকল্পনা ও অর্থায়নের কথা স্বীকার করে আদালতে কাদের খানের জবানবন্দি এবং তাঁর তিন কর্মীর সরাসরি খুনে অংশ নেয়ার কথা স্বীকারের পর এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, আগে যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাঁরা লিটন হত্যায় জড়িত নন।

তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গাইবান্ধার সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) বলছেন, মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহভাজনদের কারাগারেই থাকতে হবে।

অপরদিকে, লিটন হত্যার ঘটনার সব তথ্য উদঘাটিত হয়েছে দাবি করে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক জানিয়েছেন, আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এ মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। এতে ৮ থেকে ১০ জনকে আসামী করা হতে পারে।

বিশিষ্ট জনদের মতে, রাজনীতি সবখানে চলে না। রাজনীতিকে রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে রাখতে হয়। এই বলয়ের বাইরে রাজনীতির পরিধি বাড়লেই সেটা বুমেরাং হয়। তাদের মতে, রাজনীতি দিয়ে দেশের আইন ও বিচার চলে না। যদি চলে সেখানে সুষ্ঠ বিচার ও আইন থাকে না। তারা দু:খ প্রকাশ করে বলেন, বর্তমানে এ দেশে সেটাই বেশি হচ্ছে। যার কারণে তদন্ত গতি হারিয়ে ভিন্নখাতে চলে যায়। অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় জ্যামিতিকহারে। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায় মূল অপরাধীরা পার পাওয়ার জন্য রাজনীতির আশ্রয়গ্রহণ করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ দেশে এখন রাজনৈতিক বৈরী দলকে অপরাধী বানানোর সংস্কৃতির চর্চা বিদ্যমান। যার কারণে কোন প্রকার ছোটবড় ঘটনা ঘটলেই তার সাথে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে জড়িয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়ার ঘটনা মামূলী বিষয়ে পরিণত। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ টানতে বেশিদূর যেতে হবে না। রাজধানীর পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হরতাল-অবরোধ চলাকালে দর্জি দোকানী বিশ্বজিতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে দিবালোকে। এই ঘটনায়ও বিরোধী দলকে জড়িয়ে রাজনৈতিক হেনস্থা করা হয়। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে স্বাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের বেশ ক‘জনকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান করে। ওই রায়টি এখন উচ্চতর আদালতের এখতিয়ারে।

সর্বশেষ এমপি লিটন হত্যার পর কি দেখেছে দেশবাসীর সাথে বিশ্ববাসী? এর উত্তরও এখন জানা গেছে। শুরু থেকেই বিরোধীদের কোনঠাসা করে বক্তব্য বিবৃতি চলছিল একদিকে, অন্যদিকে ওই অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে পুরুষশূন্য করা হয়েছে, নিরপরাধ ১৫৫ ব্যক্তিকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ওই ঘটনার তদন্তকে সঠিক পথে চলতে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বাধা দেয়া হয়েছিল। যার কারণে স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের মর্জিমাফিক কাজ করেছে। তদন্তের গভীরতায় হাত দিয়ে পুলিশ যখন লিটন হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটন করতে সক্ষম হয়, তখনই তদন্তের গতি সঠিক পথে গড়ায়। এর জের ধরেই রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডাকে ছাপিয়ে পুলিশ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়ে উঠে, লিটনের মূল হত্যাকারী সাবেক এমপি কাদের খানকে গ্রেফতার করে।

সহসাই মুক্তি মিলছে না ১৫৫ জনের : গাইবান্ধার বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমপি মনজুরুল হত্যার পর এই তিনটি দলের ১৫৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এঁদের মধ্যে ২৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয় ওই হত্যা মামলায়। বাকিদের বিস্ফোরক ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা নতুন চারটি মামলা দিয়ে তাতে গ্রেফতার দেখানো হয়।

এমপি হত্যা মামলাসহ সবগুলো মামলাই হয়েছে সুন্দরগঞ্জ থানায়। ওই থানার ওসি আতিয়ার রহমান বলেন, এমপিকে হত্যার পর ১৫৫ নয়, ১১০ জনকে বিভিন্ন নাশকতা ও বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত অব্যাহত আছে। আর এমপি লিটন হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয় ২৮ জনকে। যার মধ্যে সর্বশেষ পাঁচজন হলেন সাবেক এমপি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কাদের খান ও তাঁর চারজন সহযোগী, যারা সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এর আগে হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে যে ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের মধ্যে ২১ জনই জামায়াতের নেতা-কর্মী বলে দলটির জেলা নেতারা দাবি করছেন। বাকি দুজন আওয়ামী লীগের। তারা হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আহসান হাবিব এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা মাসুদুর রহমান (মুকুল)।

বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা বলছেন, সংসদ সদস্য মনজুরুল হত্যার পরপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতারা ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে দায়ী করে বক্তৃতা দেন। ফলে পুলিশের গ্রেফতার তালিকায়ও এই দুটি দলের নেতা-কর্মীর সংখ্যা বেশি।

গাইবান্ধা জেলা জামায়াতের আমির মো. আবদুর রহিম সরকার বলেন, এমপি হত্যার পর তাঁদের দলের ১২৩ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২১ জনকে হত্যা মামলায় এবং বাকি ১০২ জনকে পুলিশের করা বিস্ফোরক আইনে তিনটি ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের করা এক মামলায় গ্রেফতার দেখায়।

জামায়াত জানায়, গ্রেফতার নেতা-কর্মীদের মধ্যে জেলা কমিটির সাবেক সেক্রেটারি শাহিন মাহমুদ, ১৯৯১ ও ’৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে জামায়াতের প্রার্থী আমিনুল হক এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পূর্ব অঞ্চলের আমির সাইফুল ইসলাম অন্যতম। বাকিরা মূলত কর্মী।

গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেন, সুন্দরগঞ্জ থানা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও বেলকা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সানোয়ার হোসেনসহ তাদের দলের ৩০ জনের মতো নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিটি মামলার এজাহারে বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে। ফলে একটি মামলায় কেউ জামিন পাওয়ার পর পুলিশ অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখাচ্ছে। এটাকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার-বাণিজ্যও হয়েছে।

বিএনপির এই নেতার দাবি, ঘটনার সঙ্গে যে বিএনপির কেউ জড়িত নন, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। তাই সন্দেহভাজন হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মুক্তি দিতে হবে।

মামলার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এমপি মনজুরুল ইসলামকে হত্যার পর ৪, ৮, ১৬ ও ২০ জানুয়ারি চারটি মামলা করে পুলিশ। এর মধ্যে তিনটি বিস্ফোরক আইনে ও একটি হয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে। এই চার মামলার এজাহারে আসামী হিসেবে ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আর অজ্ঞাতনামা আসামীর সংখ্যা ৩৯০ জন। বিএনপি-জামায়াতের গ্রেফতার নেতা-কর্মীদের বড় অংশকে ওই অজ্ঞাতনামা সন্দেহে ধরা হয়।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) শফিকুর রহমান বলেন, হত্যাকাণ্ডটি কারা ঘটিয়েছে, তা চিহ্নিত হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু যেহেতু এখনো তদন্ত চলছে এবং অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি, তাই এ ঘটনায় গ্রেফতার অন্যরা কারাগারেই থাকবেন। অভিযোগপত্র দেয়ার পর কার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, সেটা বোঝা যাবে।

দুই সপ্তাহ’র মধ্যেই চার্জশিট : লিটন হত্যার ঘটনার সব তথ্য উদঘাটিত হয়েছে বলে দাবি করে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুখ জানিয়েছেন, আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এ মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। তিনি বলেন, পুলিশের এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে মূল পরিকল্পনাকারী ও হুকুম দাতা সাবেক সংসদ সদস্য ও জাপা নেতা কর্নেল (অব.) ডা. কাদের খানসহ কিলিং মিশনে অংশ নেয়া খুনিদের গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে। অপরাধীরা প্রত্যেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে এ হত্যার ঘটনায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করায় মামলাটির রহস্য নিয়ে এখন আর কোনও প্রশ্ন নেই।

স্পষ্টভাষায় তিনি বলেন, ‘এ কথা এখন আমরা বলতে পারি, জাপা নেতা কাদের খান আবারও সংসদ সদস্য হওয়ার বাসনায় ওই আসনের সংসদ সদস্য লিটনকে গুলী করে হত্যা করিয়েছেন। এ জন্য খুনিদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করেন ডা. কাদের। তিনি আশা করেছিলেন, লিটনকে একান্ত অনুগত লোকদের দিয়ে হত্যা করার পর উপ-নির্বাচনে তিনি আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। কিন্তু উপ-নির্বাচনে তাকে জাপা মনোনয়ন না দিয়ে ব্যারিস্টার শামীম পাটোয়ারীকে মনোনয়ন দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকেও হত্যার পরিকল্পনা করেন ডা. কাদের খান। সে অনুযায়ী খুনিদের আবারও সুন্দরগঞ্জে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। শনিবার কাদের খান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার দায় দায়িত্বসহ ঘটনার ছক কীভাবে সাজিয়েছিলেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন এবং সব বিষয় স্বীকার করেছেন। কাদের বলেছেন, শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য লিটনকে হত্যা করেছেন তিনি।’

অপরাধীদের শনাক্ত করার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যারা অপরাধ করে তারা নিজেদের অবচেতন মনে কিছু প্রমাণ রেখে যায়। লিটন হত্যার ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র, বিশেষ করে গুলী এবং অন্য একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় উদ্ধার হওয়া গুলী পুলিশ হেড কোয়ার্টারে পরীক্ষা করে একই রকম বলে প্রমাণিত হয়। এরপরই মামলাটির দৃশ্যপট পাল্টে যায়। পুলিশ এ প্রমাণ পাওয়ার পর তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সন্দেহভাজন ৩ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও ঢাকা থেকে রানা নামের এক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়।

রংপুরের ডিআইজি বলেন, ‘এরপর জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশের কাছে স্বীকার করে, কার নির্দেশে তারা এ কাজ করেছে। এরপর হত্যার পরিকল্পনা, ছকসহ সব তথ্যই বেরিয়ে আসে। তাদের তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী সাবেক সংসদ সদস্য কাদের খানকে গ্রেফতার করা হয়।’ তিনি জানান, গ্রেফতার হওয়া রানাকে আদালতে উপস্থিত করা হলে তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এবং হত্যার ছকের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করে। এরপর মূল পরিকল্পনাকারী জাপা নেতা কাদের খানকে শনিবার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থিত করা হয়। সেখানে খুনের দায় স্বীকার করে পুরো ঘটনা বর্ণনা করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। ফলে এ মামলার রহস্য উদঘাটনে শতভাগ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

এক সমন্বয়ক পলাতক, আরেকজন নজরদারিতে : লিটন হত্যার অন্যতম সমন্বয়ক সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা চন্দন কুমার সরকার পলাতক রয়েছেন। আরেক সমন্বয়ক সুবল চন্দ্র পুলিশ নজরদারিতে রয়েছেন। পুলিশ একথা জানিয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, এমপি লিটন হত্যায় জড়িত গ্রেফতার হওয়া মেহেদী হাসান, শামীম মন্ডল, শাহীন, রানা ও কাদের খাঁনের গাড়ি চালক আব্দুল হান্নানের স্বীকারোক্তিতে অন্যতম সমন্বয়ক চন্দন কুমারের নাম উঠে আসে। উপজেলা আ’লীগের দফতর সম্পাদক বামনডাঙ্গার মনমথ গ্রামের কাঠ মিস্ত্রি সুশীল চন্দ্রের ছেলে চন্দনকে পুলিশ খুঁজছে সে পালতক। অপর সমন্বয়ক চন্দনের ভগ্নিপতি কসাই সুবল চন্দ্র পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে।

সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি আতিয়ার রহমান জানান, কাদের খাঁনসহ হত্যাকাণ্ডের চার কিলারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চন্দন কুমার ও তার ভগ্নিপতি সুবল চন্দ্র হত্যার সমন্বয়কারী। চন্দন ভারতে পালিয়ে গেছে। তবে সুবল চন্দ্র নজরদারিতে রয়েছে।

মামলার তদন্তকরী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবু হায়দার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার উচ্চাভিলাষে এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কাদের খাঁন। এছাড়া হত্যার সব আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে।

কাদের খাঁনের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক গ্রেফতার : লিটন হত্যা মামলায় গ্রেফতার আবদুল কাদের খাঁনের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার নাম শামীম মন্ডল (৩০)। শনিবার রাতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের মন্ডলেরহাট গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশ গতকাল সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। শামীম মন্ডল সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের মন্ডলেরহাট গ্রামের বাসিন্দা।

ওসি মো. আতিয়ার রহমান জানান, এমপি লিটন হত্যা মামলায় গ্রেফতার কর্নেল কাদের খাঁন ও হত্যায় অংশ নেয়া চার কিলার আদালতে দেয়া স্বীকাররোক্তি অনুযায়ী শামীম মন্ডলকে ওই গ্রাম থেকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করা হয়। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে রোববার বিকেলে আদালতে তোলা হয়। পরে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তবে শামীমের বাবা মহর আলীর দাবি, ১৩ ফেব্রুয়ারি শামীমকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ তাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।

নব্য জেএমবির নামে মন্দিরে হামলা করিয়েছিলেন কাদের খাঁন, দাবি পুলিশের : নব্য জেএমবির নামে গাইবান্ধার একাধিক মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন সাবেক এমপি ডা. আবদুল কাদের খাঁন। এমনটাই দাবি করেছে পুলিশ। তার নির্দেশেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সদর ও সাদুল্যাপুর উপজেলায় বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হয় জানিয়েছে পুলিশ।এখন তার বিরুদ্ধে মন্দিরে আগুন ও প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগ তদন্ত করছে পুলিশ।

পুলিশের দাবি, গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে কাদের খাঁনের নির্দেশ এবং পরিকল্পনায় মন্দিরে হামলা হয়। ৯ অক্টোবর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুরের কামারপাড়া কালিমন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ এ অভিযোগে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটি ইউনিয়নের মন্ডলেরহাট থেকে কথিত চার নব্য জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- সুন্দরগঞ্জের ফয়সাল খাঁন ফাগুন (১৭), নজরুল ইসলাম খাঁন (৩৫), আশিকুল ইসলাম (১৬) এবং শহিদ মিয়া (১২)। এদের মধ্যে ফয়সাল কাদের খাঁনের ভাতিজা। আর নজরুল ইসলাম খাঁন তার বাড়ি দেখাশুনা করতেন।

সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি মো. আতিয়ার রহমান জানান, ‘মন্দিরে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার চারজন স্বীকার করেছেন কালিমন্দিরে আগুন দেয়া ঘটনা। এছাড়া ২২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সাদুল্যাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব কেশালীডাঙ্গা সার্বজনীন মন্দিরের মূর্তিও ভাঙচুর করে তারা। ভাঙচুর করার পরে প্রতিটি মন্দিরেই নব্য জেএমবি নামে হাতে লেখা চিঠি ফেলে আসে।’

তিনি আরও জানান, ‘গত ২২ সেপ্টেম্বর তারা আরও একটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার আগেই তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।’

ওসি বলেন, ‘প্রাথমকিভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব ঘটনায় কাদের খাঁনের নির্দেশেই হয়েছিল। মন্দিরে আগুন দেয়ার ঘটনার তার ভাইয়ের ছেলে ফয়সাল গ্রেফতার হয়েছে। তাই ওসব হামলায় তার সংশ্লিষ্টার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শুরুও হয়েছে।’

৩১ ডিসেম্বর এমপি লিটন সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের সাহবাজ (মাস্টারপাড়া) গ্রামের নিজ বাড়িতে গুলীতে নিহত হন। এ ঘটনায় লিটনের বোন তাহমিদা বুলবুল বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামী করে ১ জানুয়ারী সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন।

কাদের খানের অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদক : গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আবদুল কাদের খানের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, কাদের খানের সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে সংস্থার উপপরিচালক বেনজীর আহমেদকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ অনুসন্ধানের তদারক করবেন পরিচালক কে এম জায়েদ হোসেন খান। গাইবান্ধা-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি মনজুরুল ইসলামকে (লিটন) হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন কাদের খান।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কাদের খানকে বগুড়া শহরের বাসায় ছয় দিন ‘নজরবন্দী’ করে রাখার পর গত মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন গাইবান্ধার আদালতে হাজির করে তাঁকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। ওই দিন রাতেই কাদের খানকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ছাপরহাটি খানপাড়ায় তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে ছয়টি গুলীসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন কাদের খান ঘটনাস্থলে উপস্থিত তাঁর ছোট ভাই ইউসুফ খানের স্ত্রী ফিরোজা বেগমের কাছে ক্ষমা চান।

এদিকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন কাদের খান। পুলিশি রিমান্ডে থাকার তিন দিনের মাথায় গত শনিবার তিনি জবানবন্দি দেন।

http://www.dailysangram.com/post/273632