২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১:৩৬

দেশে নিঃস্ব হয়ে বিদেশে কারাবন্দি

প্রতারিত ১৫ হাজার পরিবারে কান্না

সংসার চালাতে দিনমজুর বাবার হা-পিত্যেশ দেখে ঋণের টাকায় মালয়েশিয়ায় যান কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের সাহেব আলীর ছেলে ফিরোজ। কিন্তু দালালরা তাঁকে প্রফেশনাল ভিসার বদলে ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাঠায়। আর তাই ফিরোজের ঠিকানা এখন মালয়েশিয়ার জহুর বারুর কারাগার।

আবার ওমানের কারাগারে বন্দি আছেন ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার চরবাজিগঞ্জ ইউনিয়নের সালেপুর গ্রামের শেখ বাবুল হোসেনের ছেলে শেখ সোহান। দালালরা তাঁকে ফ্রি ভিসার কথা বলে ওমানে পাঠানোর পর দেখা গেছে সেই ভিসা জাল। সোহান ছয় মাস ধরে সেখানে কারাবন্দি।

ঋণ করে ছেলেদের বিদেশে পাঠিয়ে দরিদ্র থেকে এখন আরো দরিদ্র হয়েছে ফিরোজ ও সোহানের পরিবার। উল্টো ছেলেদের কবে ফিরে পাবে তাও অনিশ্চিত।

এ রকম ৯ হাজার ৬৪০ প্রবাসী বাংলাদেশি এখন ৩৮ দেশে কারাবন্দি বলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাবে বলা হচ্ছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীও সংসদে এ হিসাব দিয়েছেন।

তবে প্রবাসী কর্মীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা ও প্রবাসীদের মতে, প্রবাসী বন্দির সংখ্যা সরকারি এ হিসাবের প্রায় দ্বিগুণ; ১৫ হাজারের বেশি হবে। তাঁদের মধ্যে এক মাস থেকে শুরু করে ১০ বছর ধরে কারাবন্দিরাও রয়েছেন।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসী বন্দিদের দেশে ফেরত আনতে প্রতি মাসেই প্রবাসীকল্যাণ বোর্ডে একাধিক আবেদন জমা পড়ছে। বন্দি প্রবাসীদের স্বজনদের অভিযোগ, বিদেশের কারাগারে আটক বাংলাদেশিদের মুক্তির বিষয়ে দূতাবাসগুলোকে চিঠি দিয়ে জানানো হলেও সংশ্লিষ্ট লেবার উইংয়ের কর্মকর্তারা জোরালো ভূমিকা নিচ্ছেন না।

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করার জন্য সরকারের কোনো লিগ্যাল উইং না থাকায় প্রতারণার শিকার হওয়া প্রবাসী কর্মীদের বছরের পর বছর বন্দি থাকতে হচ্ছে। তা ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ঘাটতিকেও দুষছেন তাঁরা।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কেবল মালয়েশিয়ার কারাগারেই বন্দি আছেন দুই হাজার ৪৬৯ বাংলাদেশি। ভারতেও এর কাছাকাছি সংখ্যার দুই হাজার ৩৩৭ বাংলাদেশি বন্দি। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক হাজার ৯৮ জন, ওমানে এক হাজার ৪৮, সৌদি আরবে ৭০৩, বাহরাইনে ৩৭০, কুয়েতে ২৬১ এবং যুক্তরাজ্যে ২১৮ প্রবাসী কর্মী বন্দি রয়েছেন। আর জাপানে ১২৩ জন, ইরাকে ১২১, কাতারে ১১২, মিয়ানমারে ৯৮, মেক্সিকোতে ৯৭, সিঙ্গাপুরে ৮৭, তুরস্কে ৬৮, ইতালিতে ৫১, ফ্রান্সে ৪৬, অস্ট্রেলিয়ায় ৩৯, জর্দানে ৩৭ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ বাংলাদেশি কারাবন্দি। একই ভাবে জর্জিয়ায় ২৬ জন, হংকংয়ে ২৪, থাইল্যান্ডে ২৩, পাকিস্তানে ১৯, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬, নেপালে ১২, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১১, মরিশাসে ৭ ও আজারবাইজানে ছয়জন বাংলাদেশি কারাবন্দি রয়েছেন। এ ছাড়া মিসর, চীন ও ব্রুনেইয়ে পাঁচজন করে; লেবানন ও মরক্কোয় দুজন করে একং কিরগিজস্তান, মঙ্গোলিয়া ও ব্রাজিলে একজন করে আটক রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা যা বললেন : কুষ্টিয়ার দিনমজুর সাহেব আলী কালের কণ্ঠকে জানান, প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে বাড়ি বন্ধক রেখেছিলেন তিনি। সুদে আনা টাকা তো আছেই। সাহেব আলী মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলে মালয়েশিয়া যাওয়ার এক মাসের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছে। আর দেশে ঋণের টাকার জন্য মানুষ বাড়িতে আসছে, তাগাদা দিচ্ছে। নিরুপায় হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আছি। ’

ফরিদপুরের শেখ বাবুল হোসেন জানান, ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর টাকা জোগাড় করতে গিয়ে স্থানীয় সমবায় সমিতি থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সংসারের অভাব দূর করতে গিয়ে এখন আরো বেড়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এখন ঋণের টাকা শোধ করব কিভাবে জানি না। ’

একইভাবে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার রামপুর গ্রামের মৃত শাহজাহান মিয়ার ছেলে মো. কাউসার মিয়া তিন মাস ধরে মালয়েশিয়ার বেংটং কারাগারে বন্দি। কাউসারের ভগ্নিপতি মো. মুহিবুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁকে ফেরত আনার জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়েও আবেদন করছি। সেখানের দূতাবাসেও যোগাযোগ করছে আমাদের লোকজন; কিন্তু সেখানের কর্মকর্তারা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ’

এ রকম আরেকজন চট্টগ্রামের চরকবাজার এলাকার মো. ইকবাল হোসেনের ছেলে আব্বাস আলী। তিনিও মালয়েশিয়ায় আটক আছেন।

ওমানের কারাগারে পাঁচ মাস ধরে আছেন ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা গ্রামের মো. বশির আহাম্মদের ছেলে মো. মোসলেম উদ্দিন। ঋণ নিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে এখন উল্টো চাপে আছেন বশিরউদ্দিন। একদিকে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনা, অন্যদিকে ঋণের বোঝা।

বিশেষজ্ঞ মত : জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব মো. রুহুল আমিন স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসী কর্মীরা নানা কারণে কারাগারে আছেন। ওই সব কর্মীর মুক্তির জন্য পৃথক লিগ্যাল উইং করার পাশাপাশি মিডিয়া উইং করা দরকার, যাতে তারা প্রবাসী বন্দিদের মুক্তির জন্য দূতাবাসের হয়ে সরাসরি কাজ করতে পারে। ’ এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বলে জানান বায়রা মহাসচিব।

উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মী আসিফ মুনীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু জেলেই নয়; অনেক দেশে ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি করে রাখা হয় প্রবাসী কর্মীদের। ’ প্রতিটি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এবং লেবার উইংয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কারাগারে আটক প্রবাসীদের মুক্তির বিষয়ে আরো আন্তরিকভাবে কাজ করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে অভিযোগ করে আসিফ মুনীর বলেন, ‘লেবার উইংয়ের কর্মকর্তারা দূতাবাসে অফিস করেন। সেই কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রশাসনিক, পরিবহনসহ বিভিন্ন লজিস্টিক সাপোর্ট সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাবের কারণেই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবাসী কর্মীরা। ’ তিনি বলেন, দুই মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ে আরো সমন্বয় বাড়াতে পারলে প্রবাসী কর্মীরা আরো বেশি সেবা পাবেন এবং বছরের পর বছর তাঁদের কারাগারে আটক থাকতে হবে না। তবে গুরুতর কোনো অপরাধের কারণে আটক ব্যক্তিদের বিষয়টি ভিন্ন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরুর)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু দূতাবাস কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কারাগারে থাকা বিশালসংখ্যক প্রবাসী কর্মীকে মুক্তি করা কঠিন হবে। এ জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করা যেতে পারে। যেসব দেশে আটক রয়েছে ওই সব দেশের বাংলাদেশি কমিউনিটি লিডারদের একত্রে ছোট গ্রুপ করেও সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। ’

সরকারি ভাষ্য : সম্প্রতি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসী বন্দিদের প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘আটককৃত বাংলাদেশি নাগরিকরা যাতে সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত মুক্তি লাভ করতে পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাস প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তাসহ আনুষঙ্গিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। দূতাবাস মুক্তি পাওয়া অবৈধ বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ট্রাভেল পারমিট দিয়ে থাকে। ’

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শহীদুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা রুটিনমাফিক বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে যাচ্ছেন। কারাগারে বন্দি থাকা কর্মীদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহেই কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছে। ’ তবে তিনি বলেন, ‘যাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তাঁদের বেশির ভাগই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অবৈধভাবে থাকছিলেন। বাংলাদেশিরা খুবই নিরীহ এবং ভালো। এখানে বড় ধরনের কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়। ’

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দূতাবাসে লেবার উইংয়ে যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন, তাঁরা বন্দি প্রবাসীদের মুক্তির জন্য কাজ করছে। অনেকেই মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে এসেছে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/02/26/467952