২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১:১০

জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনার চূড়ান্ত খসড়ায় তথ্য

২৩ শতাংশ শিশু জন্মাচ্ছে কম ওজন নিয়ে

দেশে ২৩ শতাংশ শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে। ১৮ শতাংশ গর্ভবতী নারী অপুষ্টির শিকার। মাসহ অন্য শিশু পরিচর্যাকারীদের ৭৩ শতাংশ স্বাস্থ্যবিধি মানেন না।

দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনার (২০১৬-২০২৫) চূড়ান্ত খসড়ায় দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির এমন বিবর্ণ চিত্র রয়েছে। সাম্প্রতিক এই দলিলে আরও বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে উচ্চমাত্রায় অপুষ্টি আছে। বয়সের তুলনায় এদের ৩৬ শতাংশের উচ্চতা কম, ১৪ শতাংশ কৃশকায় ও ৩২ শতাংশের ওজন কম। অবশ্য দলিলে দাবি করা হয়েছে, গত তিন দশকে পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়েছে।

পুষ্টি কর্মপরিকল্পনার এই চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত মাসে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বিশেষজ্ঞ কমিটির তৈরি এই দলিল জাতীয় পুষ্টি পরিষদের পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এই পরিষদের সভাপতি।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ এম কিউ-কে তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ে পুষ্টি নিয়ে কাজ করার জন্য পৃথক কর্মী নেই বলে অগ্রগতি হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পুষ্টি বিভাগের পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘আমিষজাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ও ভোগ বাড়াতে গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে।’

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি এই খসড়া দলিলে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। পুষ্টিসেবার ব্যাপ্তি, মান ও পুষ্টি আচরণে উন্নতি প্রয়োজন।

এদিকে সরকার অপুষ্টি দূর করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. মুজহারুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। অপুষ্টির শিকার শিশুদের শনাক্ত করা, অপুষ্টির বিষয়ে কমিউনিটিকে সচেতন করার কর্মসূচি এখন চলছে। এ ছাড়া উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপুষ্টির শিকার শিশুদের চিকিৎসার জন্য দুটি করে শয্যা বরাদ্দ আছে। বয়স্ক ও কিশোরীদের পুষ্টি বাড়াতে দুটি প্রকল্পের প্রস্তাবও আছে।

বিবর্ণ চিত্র

কর্মপরিকল্পনা দলিলে বলা হয়েছে, অপুষ্টির প্রকোপে অঞ্চল ভেদে ব্যাপক পার্থক্য আছে। উপকূলের জেলাগুলো ও হাওর অঞ্চল তুলনামূলকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা ও অপুষ্টির নিরিখে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শহরের তুলনায় গ্রাম বেশি সুবিধাবঞ্চিত। সবচেয়ে কম সম্পদের অধিকারী এমন পরিবারে খর্বকায় শিশুর হার বেশি। আবার জাতীয় গড়ের চেয়ে যেসব জেলায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশি, সেসব জেলায় খর্বকায় শিশুর হার বেশি। পরিস্থিতি আরও খারাপ চেহারা নেয় খাদ্যের মৌসুমি টানাপোড়েনে, খাদ্যের দাম বাড়লে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে।

তবে শহর বা নগরের বস্তির পুষ্টি পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। বস্তির ৫০ শতাংশ শিশু খর্বকায়। বস্তির ৬-২৩ মাস বয়সী ৭৫ শতাংশ শিশুকে রীতি (আইওয়াইসিএফ) মেনে খাওয়ানো হয় না। বস্তিতে কিশোরী গর্ভধারণ তুলনামূলক অনেক বেশি।

দলিলে বলা হয়েছে, দেশে অতি ওজন, স্থূলতা ও অসংক্রামক ব্যাধির (এনসিডি) প্রকোপ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। প্রজনন বয়সী ৩৯ শতাংশ নারীর ওজন বেশি বা তাঁরা স্থূলকায়। প্রায় ৩২ শতাংশ পুরুষ ও ১৯ শতাংশ নারী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন অথবা তাঁরা রক্তচাপ কমাতে ওষুধ সেবন করছেন। আনুমানিক ১১ শতাংশ নারী ও পুরুষের ডায়াবেটিস আছে।

অনুপুষ্টি কণার ঘাটতি

পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনুপুষ্টি কণা (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট: যেমন ভিটামিন-এ, লোহা, আয়োডিন, জিঙ্ক ইত্যাদি) খুব সামান্য পরিমাণে দরকার হয়। কিন্তু বয়স অনুযায়ী শরীরে যেটুকু দরকার, তা না পেলে অপুষ্টি দেখা দেয়।

১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা দলিলে বলা হয়েছে, শিশু ও প্রজনন বয়সী নারীদের মধ্যে অনুপুষ্টি কণার ঘাটতি একটি চ্যালেঞ্জ। প্রাক্‌-বিদ্যালয়ের শিশুদের ২০ শতাংশ ভিটামিন-এ ও ৪৬ শতাংশ জিঙ্ক স্বল্পতায় ভুগছে। প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যালয় বয়সী শিশু ও ৪২ শতাংশ নারী আয়োডিন স্বল্পতায় ভুগছেন। ৩৩ শতাংশ প্রাক্‌-বিদ্যালয় শিশু ও ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারীর রক্তস্বল্পতা আছে। ব্যাপক হারে ক্যালসিয়াম ঘাটতি আছে শিশু ও নারীদের মধ্যে।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশির যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন এবং বাস্তবে যে পরিমাণ শক্তি সে গ্রহণ করে, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য গড়ে ৮২ কিলোক্যালরি (২,৪০০ কিলোক্যালরি বনাম ২,৩১৮ কিলোক্যালরি)। ১৯৯১-৯২ সাল থেকে মাথাপিছু দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বাড়ছে। একইভাবে আমিষ গ্রহণের পরিমাণও বাড়ছে, বিশেষ করে মাছ খাওয়ার পরিমাণ।

অনুপুষ্টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা তাহমিদ আহমেদ বলেন, অগ্রগতি হচ্ছে, তবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়। এর একটি কারণ খাদ্য নিরাপত্তার অভাব। বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে ধান, চাল, মাছের ক্ষেত্রে অগ্রগতি এনেছেন। আমিষের ঘাটতি দূর করতে ডিম ও মাংসের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আরও গবেষণা দরকার।

উন্নতি হচ্ছে না যে কারণে

দলিল বলছে, দেশের ৪৫ শতাংশ খানার মানসম্পন্ন পায়খানা আছে। অর্থাৎ ৫৫ শতাংশের নেই। প্রায় ৪ শতাংশ মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগ করে। মা, নিকটাত্মীয়সহ সরাসরি শিশু পরিচর্যাকারীদের ৭৩ শতাংশ স্বাস্থ্যবিধি মানেন না।

শিশুদের খাওয়ানোর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চর্চা (ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড ফিডিং—আইওয়াইসিএফ) ঠিকমতো হচ্ছে না। এই চর্চায় জন্মের পরই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা হয় এবং ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো হয়। ২০০৭ সালের পর থেকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর পরিমাণ বাড়লেও এখন পর্যন্ত তা ৫৫ শতাংশ।

অধ্যাপক তালুকদার বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান আইওয়াইসিএফ এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, তারা প্রতিশ্রুতি রাখেনি। তারা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।

করণীয়

চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, অপুষ্টি দূর করা একা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ আরও ১৪টি মন্ত্রণালয়কে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্ত করা হয়েছে।

অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ বলেন, কিছু কাজ এখনই হাতে নিতে হবে। ভিটামিন এ-এর স্বল্পতা দূর করতে যেমন বড়ি খাওয়ানো হয়, তেমনি যেসব ক্ষেত্রে সম্ভব সেসব ক্ষেত্রে পরিপূরক ব্যবহার করা যেতে পারে।

অধ্যাপক তালুকদার বলেন, ‘একসময় মাঠপর্যায়ে প্রায় ৪৮ হাজার পুষ্টিকর্মী ছিল। তারা মানুষকে সচেতন করত, পুষ্টির কিছু বিষয় হাতেকলমে শেখাত। এখন তারা নেই।’ তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে পুষ্টির জন্য পৃথক কর্মী বাহিনী না থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।