২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১০:১৫

এবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম

গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর এবার বিদ্যুতের দামও বাড়ছে। শিগগিরই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। আগামী এপ্রিল থেকে নতুন হার কার্যকরের প্রস্তাব করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমেছে। পাশাপাশি গ্যাসভিত্তিক কয়েকটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় খরচ আরো কমেছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে উল্টো বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংস্থাগুলো। সূত্র জানায়, এরই মধ্যে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে তা স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের প্রস্তাব করেছে পিডিবি। এতে গ্যাসের দাম বাড়লে আগামীতে বিদ্যুতের দাম শুনানি ছাড়া এমনিতে সমন্বয় করে নেবে সংস্থাটি। একইভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। এদিকে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর একদিন পর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ?্যাসের দামটা একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করতে চাই। তিনি বলেন, ভবিষ?্যতে সারা বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ করার লক্ষে?্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সুতরাং আমাদের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করার মানসিকতাও থাকতে হবে। এর আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বৃহস্পতিবার বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম মার্চ ও জুনে দুই ধাপে গড়ে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। কিন্তু তাতে আবাসিক গ্রাহকদের রান্নায় ব্যবহৃত গ?্যাস ও বাণিজি?্যক সংযোগে দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

সূত্রমতে, ২০১৫ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট) ছিল ৬ টাকা ২৭ পয়সা। গত বছর তা কমে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৮০ পয়সা। আর চলতি বছর এ খরচ আরো কমে হয়েছে পাঁচ টাকা ৫৯ পয়সা। তবে ইউনিটপ্রতি ৭২ পয়সা লোকসানের যুক্তিতে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পাইকারিতে (বাল্ক) ১৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়বে প্রায় ১০ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর সর্বশেষ বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।

একই সময় বাড়ানো হয়েছিল গ্যাসের দামও। দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একক ক্রেতা হিসেবে আইপিপি, আরপিসিএল, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইজিসিবি ও আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। উৎপাদিত ও ক্রয় করা বিদ্যুৎ বাল্ক গ্রাহক ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো, নবগঠিত নওজোপাডিকো, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কাছে পাইকারি রেটে ও পিডিবি বিতরণ অঞ্চলে খুচরা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয়। বিদ্যমান বিদ্যুতের গড় পাইকারি বিক্রি মূল্য ৪ টাকা ৮৭ পয়সা। আর সরবরাহ মূল্য পাঁচ টাকা ৫৯ পয়সা। ফলে বিদ্যমান হারে ইউনিটপ্রতি পিডিবির ঘাটতি ৭২ পয়সা। এ হিসেবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাইকারি ট্যারিফজনিত ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। এদিকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয় ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু সে সময় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঘাটতিকে ভর্তুকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও সরকার সে অর্থ ঋণ হিসেবে পিডিবিকে প্রদান করেছে। এতে বিদ্যুতের প্রকৃত বাল্ক মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৮৭ পয়সা। আবার ঋণের বিপরীতে পিডিবিকে সুদ দিতে হয়। এতে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্যারিফ ঘাটতি বেড়ে গেছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুতের গড় পাইকারি মূল্য ৫ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব পেশ করা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাস থ্রু পদ্ধতিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে বাড়তে পারে প্রায় ১০ শতাংশ। ১লা এপ্রিল থেকে এটি কার্যকরের প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও গত বছর গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দিয়ে রেখেছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে ডেসকো ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ডিপিডিসি ৮ দশমিক ৮৬, ওজোপাডিকো ১০ দশমিক ৭৬ ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।

বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় প্রথার পৃথক প্রস্তাবও করতে যাচ্ছে পিডিবি। এতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের ৬০ শতাংশই জ্বালানি ব্যয়। তাই এ ব্যয় বৃদ্ধি পেলে ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রয়োজন। সে কারণে জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তা সমন্বয়ের প্রয়োজন। এজন্য একটি প্রক্রিয়াও সুপারিশ করেছে পিডিবি। সেটি হলো বিদ্যমান মূল্য হারের সঙ্গে ইউনিটপ্রতি বর্ধিত জ্বালানি মূল্য যোগ করতে হবে। আর তা থেকে সর্বশেষ ট্যারিফে বিবেচিত ইউনিটপ্রতি জ্বালানি মূল্য বাদ দিতে হবে। তবে বিদ্যুতের স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় পদ্ধতিকে জালিয়াতি বলে মনে করেন বিদ্যুৎ খাতের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ। তিনি এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় হলো ডিজিটাল পদ্ধতি। তাই এর সঠিক বাস্তবায়ন হবে না। কারণ যে পরিমাণ বাড়ার কথা তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দেখানো হবে। ফলে জ্বালানি তেল বা গ্যাসের দাম বাড়লে ঠিকই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। তবে কমলে তা আর কার্যকর হবে না। যেমনটি জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে তেমন কমানো হয়নি। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম প্রতিকিলোওয়াট ২ থেকে আড়াই টাকার উপরে হওয়ার কথা নয়। হাজার হাজার টাকা লুটপাট করার জন্য দাম বাড়ানো হচ্ছে। দেশটাকে পঙ্গু করার জন্য এটা করা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিদ্যুতের দাম কম রাখা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবি চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে যে দামে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে পাইকারি বিক্রিমূল্য অনেক কম। গ্যাসের দাম বেড়েছে। কিছুটা সমন্বয় করা দরকার।

গত অর্থবছর পিডিবির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে সরকার এ অর্থ ভর্তুকির পরিবর্তে ঋণ হিসেবে দিয়েছে। এজন্য বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রস্তাবটি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানো হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=55022&cat=2