৩১ ডিসেম্বর ২০১৬, শনিবার, ৩:৫৯

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

নির্বাচনের সর্বশেষ সংস্করণ মৌলিক গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন?

বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় ‘স্থানীয় সরকার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল গঠনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। বাস্তবে বিগত ৪৬ বছরে এ দেশে কার্যকর স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গঠন তথা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ ধাপ হিসেবে বাস্তব কারণে কার্যকর থেকেছে। ব্রিটিশ আমল থেকে যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাটি সবচেয়ে কার্যকর ছিল তা বাংলাদেশ আমলে সবচেয়ে অকার্যকর হয়ে পড়ে। আজো গ্রামগঞ্জে জেলা পরিষদের অতীতের স্বাক্ষর হিসেবে রাস্তাঘাট, পানীয়জলের পুকুর এবং ডাকবাংলো ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। মাঝখানে উপজেলা পরিষদ নিয়ে সামরিক সরকার কার্যকর কিছু করার চেষ্টা করলেও জাতীয় ঐকমত্যের অভাবে সেটি প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেনি। বর্তমানে উপজেলা পরিষদ স্থানীয় নেতৃত্বের কোন্দলে অকার্যকর রয়েছে, যদিও এর পোশাকি চেহারা বিদ্যমান রয়েছে।
দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর বর্তমান সরকার স্থানীয় শাসনপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জেলা পরিষদ পুনর্গঠনে উদ্যোগী হয়েছে। এখন জেলাপর্যায়ে জেলা প্রশাসকই সর্বেসর্বা। রাজনীতিক ও আমলাদের টানাপড়েনে সবচেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে জেলা প্রশাসন। ১৯৭৫ সালে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জেলা প্রশাসন থেকে আমলাদের হটিয়ে রাজনীতিকদের ক্ষমতায়ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তৎকালীন ৬৪টি জেলায় গভর্নর নিয়োগ করা হয়েছিল, প্রধানত আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এ পদ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের সময় জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ চলছিল। সামরিক শাসন আমলে জেলা প্রশাসনে রাজনীতিকদের নিয়োগ লক্ষ করা যায়। জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে তাদের বলা হতো ‘ডিসট্রিক্ট কো-অর্ডিনেটর’ বা জেলা সমন্বয়কারী। এরশাদ আমলেও অনুরূপ নামে তাদের ডাকা হয়। সামরিক প্রশাসনের অধীনে, জেলাপর্যায়ের নেতৃত্ব বিকশিত হয়নি। বরং তারা জেলা প্রশাসকের প্রাধান্য মেনে নিয়েই জেলায় রাজনৈতিক সমন্বয়ের কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ এবং ২০০৯ আমলে জেলা পরিষদ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। তবে ২০১১ সালে তারা জেলা পরিষদের প্রধান হিসেবে তাদের জেলাভিত্তিক নেতাদের নিয়োগ করেছিলেন। ২০১৪ সালের প্রহসনমূলক সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ প্রতিটি স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর করার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে তথা দলীয় মনোনয়নে প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যে ‘কৌশলে’ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, প্রতিটি স্তরে সে একই কৌশলের অনুকরণ অনুসরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব নির্বাচন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একক আওয়ামী নির্বাচন। উল্লেখ্য, এ সময় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে এত রক্তক্ষয় ঘটেছে যা গত প্রায় ৫০ বছরেও দেখা যায়নি। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে যখন বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীরা জয়লাভ করতে থাকেন, তখন আওয়ামী লীগ পুরনো কৌশলে ফিরে আসে। ফলে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। পৌরসভা নির্বাচন ও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শক্তি প্রয়োগের মহড়া পরিদৃষ্ট হয় একইভাবে। কারসাজির সর্বশেষ নমুনা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দৃশ্যমান শান্তির আড়ালে অঘোষিত ভীতির মধ্যে বেশির ভাগ ভোটারকে রেখে ‘সশস্ত্র নীরবতা’য় আওয়ামী প্রার্থী জয়লাভ করে বলে অনেকেই মনে করছেন।
কৌশলের নতুন রূপ প্রদর্শিত হয়েছে এবার ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে। এ নির্বাচনটি ছিল পরোক্ষ। সংবিধানে প্রত্যক্ষ ভোটের বাধ্যবাধকতা থাকলেও জেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের অধিকার অস্বীকার করা হয়। এখানে ভোটার ছিলেন নির্বাচিত সব প্রতিনিধি। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের সব সদস্য এবং জেলার অন্তর্ভুক্ত সব পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত সব সদস্য জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা একে ষাটের দশকে আইয়ুব খান প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। এই কথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বসাধারণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে ভোটাধিকার দেয়া হয়েছিল ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের। ওই ব্যবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ হাজার করে সমসংখ্যক সদস্য ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, জাতীয় পরিষদ নির্বাচন ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তারাই ছিলেন ভোটার। নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে বিগত বছরগুলোয় যে তামাশা চলছে, তারই সর্বশেষ সংস্করণ হচ্ছে জেলা পরিষদ নির্বাচন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মন্তব্য করছেন, সরকারের মাথায় আইয়ুবের ভূত চেপেছে।
একদলীয় নিরুত্তাপ নিরানন্দ এ নির্বাচনের সম্পূর্ণ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় সব জেলা পরিষদে সরকারি দলের জয়-জয়কার ঘোষিত হয়েছে। সর্বশেষ ফলাফলে দেখা যায়, ৫৯টি জেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৫টি পদে জয়লাভ করেছে। জেলা পরিষদের ২০টি সদস্যপদ ও সংরক্ষিত ৫টি মহিলা আসনের পদগুলোয় আওয়ামী লীগের প্রাধান্য বহাল রয়েছে। জাতীয় সংসদের ২০১৪ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনেও ২১ জন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘জয়লাভ’ করেছেন। বিনা ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যা ২৫৬। জেলা পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী ১৪৬ জনের মধ্য থেকে কোনো বিরোধীদলীয় প্রার্থী জয়লাভ করেননি বলা চলে। তবে আওয়ামী লীগের ১২ বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। আর স্বতন্ত্রভাবে বিজয়ী হয়েছেন ১২ জন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নীতিগতভাবে তারা পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিকে গ্রহণ করেনি। অপর দিকে বাস্তবে তাদের প্রার্থী দেয়া কঠিন এ জন্য যে, গত নির্বাচনগুলোয় ক্ষমতাসীনদের কারসাজি ও বল প্রয়োগে অত্যল্পসংখ্যক সদস্য স্থানীয়পর্যায়ের নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। জাতীয় সংসদে তথাকথিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রাধান্য আছে, এমন জেলাগুলোয় অংশগ্রহণ করে। ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলটি ছোট ছোট দলের প্রার্থীরাও অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের জয়লাভের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ। ৩০টি চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সর্বাত্মক চেষ্টা করেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে রাখতে পারেনি। জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের সংখ্যা সীমিত হওয়ায় নব্য ধনিক শ্রেণী অর্থের বিনিময়ে ভোটে জেতার চেষ্টা করেছে। গণমাধ্যমে অর্থের ব্যাপক ছড়াছড়ির বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একটি ভোটের দাম ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জনগণের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় ভোটের দিন তেমন সন্ত্রাস-সহিংসতা হয়নি। তবে পরোক্ষ ভোটাররা ভয়ভীতি ও সন্ত্রাস-সংহিসতার শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রায় সব জেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত লোকজন মোতায়েন করা হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি ঘোষণা করলেও সরকারি দলের লোকেরা তা তোয়াক্কা করেননি। দেশের সাত জেলায় অন্তত ১১ জন এমপি নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নির্বাচনের সময় নিজ নিজ জেলায় অবস্থান করেছেন। প্রার্থীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন তারা পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। কেউ কেউ ভোটের বিনিময়ে টিআর ও কাবিখা বরাদ্দের কথাও বলেছেন। বরিশালের একজন ‘গডফাদার’ এবং তিনজন এমপি বিজয় দিবস উপলক্ষে নিজ বাসভবনে ভোটারদের বিরিয়ানি খাইয়ে ভোট চেয়েছেন। এ সবই নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশন এসব জানা সত্ত্বেও তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উল্লেখ্য, জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সর্বশেষ নির্বাচন।
গোটা নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং ফলাফল বিশ্লেষণ করে যে কেউ বুঝতে পারবেন, এটি ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একক মহড়া। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ মন্তব্য করেন যে, একদলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচনের সার্থকতা প্রমাণ করে না। বরং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি অর্থবহ হতে পারত। এ ধরনের একক প্রদর্শনী সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং কালো টাকার প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্য করেন, ক্ষমতা আর জনপ্রতিনিধিত্ব আজ অর্থবিত্ত তৈরির মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এ জন্যই কিছু রাজনৈতিক নির্বাচনে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। নির্বাচিত হওয়ার জন্য দুর্বিনীত হয়ে ওঠে অনেকে। তাদের নির্বাচিত হওয়া অর্থবিত্তের দুয়ার, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির পথ খুলে দেবে। জেলা পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। প্রথমত, সর্বজনীন ভোটাধিকার বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত। ব্যতিক্রম লক্ষ করা গেছে। দ্বিতীয়ত, পরোক্ষ নির্বাচনের প্রভাব গোটা নির্বাচনব্যবস্থাকে বিঘিœত করবে। তৃতীয়ত, নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রত্যক্ষভাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা, কায়েমি স্বার্থবাদ এবং জনবিচ্ছিন্নতা দ্বারা জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চতুর্থত, জেলার উন্নয়ন কার্যক্রমে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত না হওয়ার শঙ্কা থেকে যাবে। পঞ্চমত, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং জেলা প্রশাসকের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিভাজন স্পষ্ট না হওয়ার কারণে ক্ষমতার দ্বৈধতা এবং সীমানা নিয়ে প্রশাসনিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। প্রকৃত অর্থে, জেলা প্রশাসনকে কার্যকর ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু করতে এর কাঠামোগত সংস্কার ও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জেলাকে সব উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জনগণই যদি ক্ষমতার উৎস হয় তাহলে স্থানীয়পর্যায় থেকে জাতীয়পর্যায়ে প্রকৃত অর্থেই জনপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তাহলেই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের যথার্থ সমন্বয় হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183171